বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব শোষিতের গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারীদের কূটকৌশল

শামসুজ্জামান খান 

বঙ্গবন্ধু কামাল আতাতুর্ক বা জামাল আবদুন নাসেরের মতোই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণের জন্য তাঁরা যে কিছুটা জোর-জবরদস্তি খাটিয়েছিলেন, ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু আশ্চর্য দক্ষতায় তা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় আস্থার ফলে হতদরিদ্র কিন্তু শ্রমনিষ্ঠ ব্যাপক কৃষক সমাজ, সংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু সকল মানুষের মতের ভিত্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রনীতি করতে পারা বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও স্পর্শকাতর বিষয়কে জনগ্রহণযোগ্য করার নিপুণ দক্ষতার পরিচায়ক। এই অনন্য সাফল্য তাঁর ইতিহাস-বোধেরও পরিচায়ক। বাংলা ও ভারতবর্ষের হাজার বছর ধরে বিকশিত সমন্বিত জীবনধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতির ঐতিহাসিক পটভূমি জানতেন বলেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করেছিলে। কারণ মধ্যযুগ থেকেই আমাদের এই অঞ্চলে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম সম্প্রদায় এবং উপধর্ম-কাল্ট (ঈঁষঃ) আদিবাসী ও গৌণ-ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিশ্ববীক্ষা (ডড়ৎষফ ঠরব)ি ও জীবনদৃষ্টির মিথস্ক্রিয়া (ওহঃবৎধপঃরড়হ)-জাত সমন্বয়বাদিতার প্রক্রিয়া থেকে যে সমন্বয়ধর্মী, পরমতসহিষ্ণু ও সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী সংস্কৃতি ও ভাবুকতার ধারা নির্ভর বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে তার উপলব্ধি বঙ্গবন্ধুর ছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে উপর্যুক্ত উপাদানের যেমন প্রাধান্য আছে তেমনি আধুনিককালের ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক আদর্শের জনগণের সাবভৌমত্ব ও ক্ষমতার মালিকানা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্যহীনতার আদর্শও যুক্ত হয়ে যায়। বস্তুতপক্ষে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের জনগণের শতসহস্র বছরের ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত চিন্তাচেতনার ধারা, এই অঞ্চলের নানা জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষাকে অন্বিত করে তাদের একটি জাতিতে পরিণত করেছে। এবং ইংরেজ আমলে ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং পাকিস্তানে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থ ও সুবিধার জন্য ব্যবহার করে বাংলা ও বাঙালিকে চরম বৈষম্য ও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকারে পরিণত করায় প্রধানত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধাপে ধাপে নানা ও মাত্রিক গণসংগ্রাম এবং এর সর্বোচ্চ স্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এর আধুনিকতা ও মৌলিকত্ব ছিল অনন্য।
দুই.
এই নব-সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রটি নিয়ে এখন আমরা কিছুকাল আগে বেশ উদ্বেগ ও শঙ্কায় ছিলাম। এর মৌলিক চরিত্র ও আধুনিক সত্তাকে ইতোমধ্যে বিকৃত করেছেন দুই স্বৈরাচারী সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ এবং এক নব্য মীর জাফর খন্দকার মোশতাক। এদের মধ্যে দুজন দেশের প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা-ে যুক্ত ছিলেন বলে বই-পুস্তক ও দলিলপত্রে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এরা সংবিধান ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে যে স্বেচ্ছাচার করেন এবং একজন বিচারপতিকে শিখন্ডী দাঁড় করিয়ে যে অদৃশ্য ও হীন খেলা খেলেন তা ছিল এব কলঙ্কময় অধ্যায়। সম্প্রতি হাইকোর্ট এক রায়ে এঁদের ক্ষমতা গ্রহণকে বেআইনি ও সংবিধান বিরোধী ঘোষণা করে এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এরশাদ ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ করে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোই বদলে ফেলেন। জেনারেল জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর পথ করে দেন। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রসত্তা পাকিস্তানি ধারায় পুনঃপ্রবর্তিত হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান ও তাঁর সমর্থকরা বলেন, জিয়া নাকি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা, জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশকে স্পর্শকাতর বিষয় যুক্ত করে ঢেকে দেয়া এবং তাঁর ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের প্রহসন আর যাই হোক গণতন্ত্র নয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র হলে তাঁর গণভোটে অন্য কোনো দলের এমনকি স্বতন্ত্র কাউকেও দাঁড়াতে দেয়া হয়নি কেন?
যে জন্য জিয়াউর রহমানের মতো ধূর্ত শাসককে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে কেউ কেউ প্রচার করেন তার কারণ বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশাল’ গঠন। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কেউ বিব্রতবোধ করি, কেউ এড়িয়ে যেতে চাই। আমরা মনে করি এ বিষয়টিকে এভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অনুচিত। প্রথম কথা হল : এটি ইতিহাসের অংশ। তাই ইতিহাসের একটা অংশকে চেপে ঢেকে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। বঙ্গবন্ধু বাকশাল তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন জাতীয় সংসদে বিপুল ভোটে পাস করে। জিয়ার মতো সামরিক ফরমান জারি করে জাতীয়তাকে ‘বাঙালি’ থেকে ‘বাংলাদেশি’ করে নয়; চরম স্বৈরতান্ত্রিক একক প্রার্থিতার হ্যাঁ-না’র গণভোটের প্রহসনে নয়। বঙ্গবন্ধু বাকশাল করার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন : “ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করলাম, কত জেল খাটলাম আর এখন এক পার্টি করতে যাচ্ছি। আগস্ট মাস থেকে বাকশালের কাজ পুরোপুরি শুরু হবে। আমি এটা চাইনি। বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। পাকিস্তানপন্থি, বিভিন্ন ইসলামী দল আর অস্ত্রধারী জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি প্রভৃতি প্রশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভেঙে ফেলার উপক্রম করে ফেলেছে। আমার বহু লোককে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। ঈদের দিন নামাজের মধ্যে হত্যা করা হয় শুনেছেন কখনো? অতএব, অন্য কোনো পথ খোলা না দেখে আমি স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের নিয়ে সমমনাদের একটি রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে বাকশাল গঠন করেছি। আমি সমাজতন্ত্রবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো দল বা ব্যক্তিকে বাকশালে নেব না। আরো একটি কথা, আমার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নয়, দেশকে বাঁচানোর জন্য এই পদক্ষেপ। আমি ক্ষমতা অনেক পেয়েছি, এমন আর কেউ পায়নি। সে ক্ষমতা হলো জনগণের ভালোবাসা ও নজিরবিহীন সমর্থন।… আমার এই একদলীয় ব্যবস্থা হবে সাময়িক। দেশটাকে প্রতি বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করে আমি আবার গণতন্ত্রে ফিরে যাব। মনে রাখতে হবে, বিশ^ এখন দুই ভাগে বিভক্ত; শোষক আর শোষিত। চেষ্টা করব আমার গণতন্ত্র যেন শোষকের গণতন্ত্র না হয়। আমার দুঃখী মানুষ যেন গণতন্ত্রের স্বাদ পায়। আমার গণতন্ত্র পশ্চিমা গণতন্ত্রের মতো বৈষম্যমূলক এবং শোষণের হাতিয়ার হবে না।
বাকশাল কী অবস্থায়, কেন, কাদের নিয়ে করা হয়েছিল এবং তা যে একটি স্থায়ী ব্যাপার নয়, সাময়িক ব্যবস্থামাত্র; শোষিতের গণতন্ত্রই তাঁর লক্ষ্য-একথা তো বঙ্গবন্ধু স্বয়ংই বলে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ধর্মজ ও জাতিগত আধিপত্যের তথাকথিত গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণহীন র‌্যাডিক্যাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাটাতন হিসেবেই বাকশাল গঠন করেছিলেন। তাঁর নির্বাচিত জেলা গভর্নর প্রথা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতো। এবং ইংরেজ প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর (ইৎরঃরংয ওসঢ়বৎরধষ ঈরারষ ইঁৎবধঁপৎধপু) জায়গায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত তৃণমূলভিত্তিক এক নতুন গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠত। শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব। তাঁকে হত্যা করার পর বিবিসি তাই এক সংবাদ ভাষ্যে বলেছিল : পৌনে দুইশ বছরের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের পর এই প্রথম শেখ মুজিব এক নতুন ধরনের স্থানীয় সরকারভিত্তিক শাসন কাঠামো গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
শেখ মুজিব সাহসী ছিলেন, ছিলেন সাধারণ ঘরের সাধারণ মানুষের মতোই সরল তবে সময়োপযোগী রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সুদক্ষ। গণমানুষের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক এবং তাঁর প্রতি মানুষের অগাধ বিশ্বাস থেকেই এসেছিল ওই অমিত সাহস এবং মানুষের মন বুঝে সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। শেখ মুজিব কি কখনো রাজনৈতিক মিথ্যাচার, শঠতা ও চাণক্যনীতির আশ্রয় নিয়েছেন? না, কেউ তা বলতে পারবে না। তাহলে গুরুতর বাংলাদেশবিরোধী ধর্মব্যবসায়ী এবং উগ্রবাম ও কতক বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার ত্রিমুখী অন্তর্ঘাতমূলক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তাঁর নেয়া একটা দুঃসহ অবস্থা মোকাবিলার সাময়িক ব্যবস্থা নিয়ে যারা তাঁকে স্বৈরাচারী বলে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাদের ত্যাগ স্বীকার কতটুকু? আজীবন সংগ্রামী শেখ মুজিবের চেয়েও বেশি?
এছাড়াও ওই সময়ে বিশ্বপরিস্থিতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ পরবর্তীকালে এশিয়ান টাইগার্স হিসেবে উঠে এসেছে তাদের মধ্যে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ও স্থিতিশীল পরিবেশে অর্থনৈতিক বিকাশের ব্যবস্থা তো অনেক দেশেই ছিল। অতএব, শেখ সাহেব যদি ওইসব দেশের অনুকরণে বাকশাল গঠন করে দ্রুত আর্থিক বিকাশ ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়ে থাকেন তাহলে তো তাঁকে দোষ দেয়া যায় না। তিনি যা করেছিলেন তা সাংবিধানিকভাবেই করেছিলেন। সেজন্যই হাইকোর্টের রায়ে মোশতাক, সায়েম এবং জিয়ার শাসনক্ষমতা গ্রহণকে বেআইনি বললেও বঙ্গবন্ধুর বাকশার প্রবর্তনের চতুর্থ সংশোধনীকে বেআইনি বলা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়ই বলতে হয়, ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস সমরনায়কদের কাছ থেকে সুবিধাভোগী তথাকথিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক (এদের মধ্যে অনেকে সবার আগে বাকশালে যোগ দেন) এখন বঙ্গবন্ধুর আইনসঙ্গত পন্থায় নেয়া ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করেন এবং বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী সামরিক শাসন জিয়াকে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার বানাতে চান।
সবচেয়ে বড় দুঃখ ও হতাশার কথা, খালেদা জিয়ার বাকশালের নিন্দা করা। কারণ, কাকরাইলে কেন্দ্রীয় বাকশাল অফিসে জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়াকে আমি নিজ চোখে দোতলায় সেমিনার কক্ষে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে (বাইরে খোলা অঙ্গনে) দেখেছি। বাকশাল এত নিন্দনীয় হলে তাঁরা কেন গিয়েছিলেন (দৈনিক সংবাদ, ৮ মার্চ ১৯৭৫, কাগজে সে ছবিও আছে)? এটা তো রাজনৈতিক সততার পরিচয় নয়।

শামসুজ্জামান খান : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।
সুত্র: ভোরের কাগজ, 
প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২০ 

SUMMARY

2668-১.jpg