বোরহান বিশ্বাস
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় শিশু দিবস পালিত হয়ে থাকে। শিশু দিবস প্রথমবার তুরস্কে পালিত হয় ১৯২০ সালের ২৩ এপ্রিল। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনকে (১৭ মার্চ) শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শিশুদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ দিবসটি পালন শুরু হয়। ২০০১-০৬ পর্যন্ত মেয়াদে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে, ওই সময় আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ সংগঠন এবং সমমনা দলগুলো নিজেদের উদ্যোগে বেসরকারিভাবে দিনটি পালন করতো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুণরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৭ মার্চ জাতীয় শিশুদিবস আবার পালন করা শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ছোটবড় সবার কাছে প্রিয়। শিশুদের তিনি খুবই ভালোবাসতেন। তাদের কল্যাণের কথা ভেবেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) করেন। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়। এতে সব ধরণের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
পিতার সঙ্গে হাঁটছে রাসেল। ছবি: ফাইল।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ি আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করে এক শিশু। তার নাম রাখা হয় শেখ রাসেল। রাসেলের যেদিন জন্ম হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সেদিন রাজনৈতিক কাজে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। তার প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবীখ্যাত ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ওই বৃটিশ দার্শনিকের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রেখেছিলেন রাসেল।
ছোট্ট জীবনের বেশিরভাগ সময়ই বাবাকে ছাড়া কেটেছে রাসেলের। রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী হয়ে দিনের পর দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। বাবাকে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছাকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। বাবাকে কাছে না পাওয়ার চাপা কষ্ট যেমন শিশু রাসেল অনুভব করতেন, তেমনি বাবা শেখ মুজিবও কারগারে থেকে ছেলের কথা ভাবতেন। যা বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ফুটে উঠেছে।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের পরে রাজবন্দী হিসেবে জেলে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই বাবাকে রেখে আসতে চাইছিলেন না। এ কারণে তার মন খারাপ থাকতো। সেই কথা স্মরণ করেই বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো।’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা তার ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’
একই গ্রন্থের আরেক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় সব সময় ছায়ার মতো থেকেছে শিশুটি। বাবা রাষ্ট্র পরিচালনার অতি ব্যস্ততার ভেতরেও স্নেহের ছোট ছেলেটিকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় অতিথিদের অভ্যর্থনা বা বিদেশ সফরকালে শেখ রাসেলও তার সঙ্গে ছিলেন। বিশেষ করে জাপান সফরে শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন শেখ রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি। ঘাতকরা যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলো তখন আতঙ্কিত মনে শিশু রাসেল কেঁদে বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’
পিতা এবং রাসেল। ছবি: ফাইল।
ঘাতকরা মায়ের সঙ্গে দেখা করানোর কথা বলে রাসেলকে নিয়ে গিয়েছিল। মায়ের কাছ থেকে সে আর ফিরে আসেনি। মায়ের কোলেই যেন চির শান্তির ঘুম দিয়েছিল রাসেল। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটেছে। কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি।
রাসেলের কান্না সেদিন ঘাতকদের মন টলাতে পারেনি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী ধানমন্ডির সে বাড়িটিতে সেই কালরাতে সর্বশেষ হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য রাসেলকে।
ঘাতকরা রাসেলকে হত্যা করলেও মুছে দিতে পারেনি তার পদচিহ্ন। প্রতি ১৭ মার্চ শিশু দিবসে কোটি কোটি শিশুর মধ্য দিয়ে রাসেল ফিরে আসে বাংলার বুকে। নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, মায়া ভরা সেই মুখখানি! ছোট্ট শিশুদের ভিড়ে আমরা খুঁজে পাই সেই রাসেলকে, শেখ রাসেলকে।
লেখক: সাংবাদিক
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০