মিল্টন বিশ্বাস
ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তাঁর আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের গুপ্ত কমিউনিস্ট সর্বহারাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং সর্বহারারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের হত্যা করেছিল তার চিত্র রয়েছে কয়েকটি গল্পে।
এক নতুন বাঙালি জাতির যোদ্ধা-নেতারূপে মুজিবের আবির্ভাব বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের জন্য তাঁর আজীবন সংগ্রামেরই যুক্তিযুক্ত পরিণতি। মুজিব হয়তো এখন ঢেউয়ের চূড়ায় সওয়ার হয়েছেন; কিন্তু ওখানে তার কথাটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়।’ (রাজনীতির কবি, বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম, পৃ. ৯১) অর্থাৎ এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে শেখ মুজিবের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাসকে। যৌবনে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া, গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন, সেখানে মুসলিম সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করা এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন, মুসলিম লীগের যুবনেতা হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তৃণমূল পর্যায়ে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা সবই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের রাজনীতিকেন্দ্রিক ঘটনা। (দ্রষ্টব্য: মোনায়েম সরকার [সম্পা.], ২০০৮, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, ১ম ও ২য় খ-, বাংলা একাডেমি) তবে তিনি গণতন্ত্র ও রাজপথের রাজনীতির সঙ্গে উদার নৈতিক চেতনা পেয়েছেন সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য থেকে। যাঁকে তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের সব জায়গায় ‘শহীদ’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে দলটির নামকরণ হয় ‘ছাত্রলীগ’। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। দলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রগামী করেছিল। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ইসলাম ও বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের সামগ্রিক মঙ্গল প্রত্যাশায় উজ্জীবিত ছিলেন আমৃত্যু। আবার বাঙালির দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনাও করেছেন নির্মমভাবে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশে তিনি লিখেছেন ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি।’ কাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, পৃ. ৪৭-৪৮)
মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ধর্ম ছিল ইসলাম এবং হযরত মুহম্মদ (দ.) তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় পয়গম্বর ছিলেন। কিন্তু অন্য সব ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে একজন একনিষ্ঠ মানব পূজারি। সব ধর্মই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত সেই কল্যাণধর্মের তিনি ছিলেন উপাসক। একজন মুসলমান হয়েও এই কল্যাণধর্মের উপাসক হওয়া যায় এতে তাঁর কোনো মানসিক বিরোধ ঘটেনি। কেননা তাঁর মতে, ইসলাম মানব-কল্যাণ চেতনার উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ কারণেই একজন যথার্থ বাঙালি এবং একজন মুসলমান হওয়ার পথে কোনোদিন তিনি কোনো বিরোধের সম্মুখীন হননি। (দ্রষ্টব্য : ড. সুনীল কান্তি দে সম্পা.], ২০১০, বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র, অঙ্কুর প্রকাশনী) তিনি যে বাঙালি এজন্য গর্বিত, আবার তিনি যে মুসলমান এজন্যও তাঁর গর্ব কম ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনে প্রাণে বাঙালি। রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পর্বে দলের বিশ্বাস ও নিজের জীবন দর্শনকে একীভূত করে নিয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের অপব্যবহার ও সমাজে ধর্মের নামে হানাহানির ঘটনা দেখেছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মকে সামনে রেখেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে শাসন ও শোষণ করেছে। এজন্য সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মকে মেনে নিয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। সব ধর্মের সহাবস্থান এবং বদ্ধ চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়। সারা ভারতজুড়ে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকার কথা আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৬৩ থেকে ৭৫ পৃষ্ঠায়। প্রথাবদ্ধ, ধর্ম-শাসিত সংস্কারাছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ধর্মের গণ্ডি ভেঙে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল তাঁর নীতি আদর্শ। বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি তাঁর রাষ্ট্র পরিকল্পনায়, সংবিধান প্রণয়নে। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ১০৩)
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্বদিন পর্যন্ত দেশের গণমানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তিনি সবসময় শোষিতের মুক্তি কামনা করেছেন। আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সকল অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচিতেও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।’ (দ্রষ্টব্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি) সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে ১৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, ১ম ও ২য় খ-) এসব মুনাফাখোর কালোবাজারিদের কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি করে দেন তিনি। এসময় তিনি শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য ধৈর্য ধরে কাজ করার কথাও বারবার উল্লেখ করেন। আত্মজীবনীর বিবরণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হন। তিনি বলেছেন, দেশ ভাগের পর ভাষা-আন্দোলন ও ছয়দফা পর্যন্ত যদি বাংলার রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করো, তাহলে দেখবে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলার সুপ্ত চেতনার জন্ম সাতচল্লিশের বাংলাভাগের আগেই এবং সেই চেতনারই প্রথম বহিঃপ্রকাশ আটচল্লিশ সালেই অসাম্প্রদায়িক ভাষা-আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। আর ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ২০৯-১০) রাজনীতি করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নানা সমস্যা ও সংকটময় পথ পরিক্রমা করতে হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’ (দ্রষ্টব্য: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত) একইসঙ্গে তিনি বলে গেছেন অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শের কথা। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর আচরণের সমালোচনা করার সময় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্রদের কর্মকা-কেও তিনি একটি মন্তব্যে স্পষ্ট করেছেন। ‘দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্তু তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৯) এতৎসত্ত্বেও জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন তিনি সাহসের সঙ্গে; পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন দৃঢ় চিত্তে।
৩.
মূলত ২০২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মশতবর্ষে এসে বলতে হয় বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি প্রভাব বিস্তারি শব্দ। স্বাধীনতার আগে ভাষা-আন্দোলন এবং পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের এমন কোনো বিষয় নেই যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ছিলেন। তিনি মানুষের চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছে। ভারতীয় সাহিত্যে মাহাত্মা গান্ধী যেমন মানুষের কাছে লেখার উৎস ও প্রেরণায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু অনেক লেখককে কেবল নয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে উন্মোচিত হয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা-মননে অব্যক্ত বেদনার নির্ঝর নিঃসরণ হয়েছে। আবার বাংলা শিল্প-সাহিত্যে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দুঃখ বাংলাদেশের সাহিত্যে জন্মশতবর্ষেও ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ নাম দিয়ে একটি সময়-পর্ব এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে ‘গান্ধী-যুগ’ বলে একটি কালপর্ব নির্দিষ্ট হয়েছে। বিশেষত ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের দু’যুগের বেশি সময় ‘গান্ধী-যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত। কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের পটভূমি বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে। মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মীতা, বক্তব্য, তাঁর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুরই দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মীতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাঁকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। সাধারণ জনতার কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাঁর জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে তাঁরা ১৯৭৭ সালের পর সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আর আবুল ফজল ও ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্প অন্যদিকে ভুবনখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের চিত্রকলা প্রথম থেকেই আমাদের অন্তর ছুঁয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সংগোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদগম হয়েছে। ধনী থেকে গরিব, জ্ঞানী থেকে নিরক্ষর তাঁকে কেন্দ্র করে রচিত ও পরিবেশিত গানের মুগ্ধ শ্রোতা এখনো। যে জনতা নয় মাসের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে, ১৫ আগস্টের পরে সেই দেশবাসীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদ টের পেয়েছিলেন সকলে। অসহায়, দুখী, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁকে সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে হয়েছিল।
মূলত বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, তাঁর অতি সাধারণ জীবন-যাপন তাঁকে লেখকদের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। তিনি যদিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাঁর সম্পর্কে কিংবদন্তির প্রয়োজন ছিল না যদিও তাঁকে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নানান রহস্যময় ঘটনার প্রসঙ্গ। রাজা রাও, মুলক রাজ আনন্দ এবং আর কে নারায়ণের গল্প-উপন্যাসে গান্ধীকে যেমন কাহিনী বর্ণনায় নানা ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তাঁর আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের গুপ্ত কমিউনিস্ট সর্বহারাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং সর্বহারারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের হত্যা করেছিল তার চিত্র রয়েছে কয়েকটি গল্পে। সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা ও ভালোবাসায় সবাইকে কাছে টানা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশিষ্টতা। অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেয়া, সৎ ও নীতিপরায়ণ থাকা এবং ভ-ামি না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেয়া, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা না করা তাঁর সমগ্র জীবনের মুখ্য আদর্শ। বর্তমান বাংলা শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর সেই চেতনা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্রই। মূলত তাঁর চেতনার প্রভাব শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রসারিত হয়েছে এবং আগামীতে তা বহাল থাকবে জন্মশতবর্ষে এই প্রত্যাশা আমাদের।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০