শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির চেয়ে জেল খানায় মৃত্যুই শ্রেয় : বঙ্গবন্ধু


লে. কর্ণেল সৈয়দ হাসান ইকবাল (অব.) :
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষে তিনি জীবনের সকল আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেন এবং দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। তদানিন্তর পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসন আমলে প্রায় ১৩ বছরই বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্ধি জীবন যাপন করেন। তাঁর জীবন ও যৌবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে কারাগারে।

“কারাগারের রোজনামচা”-শেখ মুজিবুর রহমান এর ডায়েরি পড়ে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের বিভিন্ন সময় ও কষ্ট-ক্লেশের বিষয় অবহিত হওয়া যায়। উক্ত “কারাগারের রোজনামচা” প্রকাশের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সশ্রদ্ধ সালাম, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।

 
১৯৪৭ সনের ১৪ই আগষ্ট তদানিন্তন পাকিস্তান নামক একটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তৎকালিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জনাব কায়েদে আযম পূর্ব পাকিস্তানে কোন এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন “Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan” উক্ত বক্তব্যের মধ্যে বাঙ্গালী জাতীর স্বাধীনতার সব স্বপ্নই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

সে প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু) বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালীর স্বাধীকার আদায়ের অন্য কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য ১৯৪৮ সনের ০৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সংগঠিত করেন। ১৯৪৮ সনে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। উক্ত বছরই ১১ই মার্চ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন এবং তিনি গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ তিনি মুক্তিপান। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রতি জেলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১৯৪৮ সনের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেফতার করে। ১৯৪৯ সনের ২১ জানুয়ারি তিনি মুক্তিপান। মুক্তি পেয়েই তিনি জনমত সৃষ্টির লক্ষে দেশব্যাপী সফর শুরু করেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবির প্রতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সমর্থন জানান এবং তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সে প্রেক্ষিতে তদানিন্তন সরকার বঙ্গবন্ধুকে ১৯৪৯ সনের ১৯শে এপ্রিল পুনরায় গ্রেফতার করে এবং তিনি জুলাই মাসে মুক্তি পান।

বিশেষ উল্লেখ্য ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগঠিত করেন। ১৯৪৯ সনের ১৪ আক্টোবর ঢাকা শহরে আর্মানিটোলা ময়দানে ভুখা মিশিন বের করেন। দরিদ্র মানুষের খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিশিন হতে তৎকালিন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শাসসুল হক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু) গ্রেফতার হন। এবার প্রায় ২ বছর ৫ মাস বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন জেলে আটক রাখা হয়। তিনি ১৯৫২ সনে ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর কারাগার হতে মুক্তি লাভ করেন।     

১৯৫০ সনে বঙ্গবন্ধু রাজবন্দি হিসাবে ঢাকার কেন্দ্রীয় গায়া কারাগারে আটক ছিলেন। তদানিন্তন সরকার বুঝতে পেরেছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীকার আদায়ে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত অনড়। সেজন্য পাকিস্তান সরকার বার বার কারাবন্দি করেও কোনো সুফল পাচ্ছিল না। তখন তারা নানাবিধ কলা কৌশল গ্রহণ করতে চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুকে তদানিন্তন পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করার জন্য চেষ্টা করা হয় কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর দলীয় রাজনৈতিক আদর্শে অটুট থাকেন।

১৯৫০ সনের জুন মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্বাক্ষাৎ করতে চান কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা প্রত্যাখান করেন। ১৫ জুন ১৯৫০ সনে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আইবি (IB) এর এস আই মুন্সী হোসেন উদ্দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বিকেল সাড়ে ৫ টায়। উক্ত স্বাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান তদানিন্তন পাকিস্তান সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি পূর্ব বাংলায় মিলিটারি একাডেমি ও শিল্প কারখানা স্থাপন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পাকিস্তান রাষ্টের ৩/৪ অংশ কর পূর্ব বাংলা হতে প্রদানের পরেও শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো উন্নয়নের প্রচেষ্টা হয়নি বলে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর স্বাধীকার আদায়ের ব্যাপারে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থায় অনড় থাকেন।

 
শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সনের ১৫ই জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তৎকালিন সরকার এর  এস আই (আইবি) মুন্সী হোসেন উদ্দিনকে শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন “কোনো শর্ত স্বাপেক্ষে মুক্তির চেয়ে কারাগারে মৃত্যুই তাঁর কাছে শ্রেয়”। 

উক্ত বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন প্রদান করা হয় ডিএস-৫ (আইবি) কে ১৯৫০ সনের ১৬ জুন তারিখে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অটুট এবং অনড়। 

বিশেষ উল্লেখ্য উক্ত এস আই (আই বি) মরহুম মুন্সী হোসেন উদ্দিন বর্তমানে নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামের কৃতি সন্তান। তিনি অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে বঙ্গবন্ধুর মত একজন উচ্চ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে কারাগারে স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তিনি সরকারের নিকট সঠিক তথ্য ‍উপস্থাপন করেন যাহা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জনাব মুন্সী হোসেন উদ্দিন এর সুযোগ্য পুত্র জনাব মো. শহীদুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিভাগ হতে ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৪ দলের জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং ঢাকা সিটি পূ্র্বের সভাপতি হিসেবে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাছাড়া জনাব শহীদুল ইসলাম অনেক সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছেন। তিনি বর্তমানে বৃহত্তর যশোর সমিতির নির্বাচিত সহ-সভাপতি এবং ঢাকাস্থ নড়াইল জেলা সমিতির প্রাক্তন সভাপতি। যাত্রাবাড়ি এলাকায় তিনি অত্যন্ত সৎ জন ও পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

 
লেখক. লে. কর্ণেল সৈয়দ হাসান ইকবাল (অব.)
সাধারণ সম্পাদক
নড়াইল জেলা সমিতি, ঢাকা

SUMMARY

2660-১.jpg