উদিসা ইসলাম
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা হতে পারে না বলে ফের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১১ মে রংপুরে এক ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণদানকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘোষণা দেন।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু জানান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তান আমাদেরকে স্বীকৃতি দিক আর না দিক তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা তাদের স্বীকার করি কিনা সেটাই এখন বড় কথা। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো পাকিস্তানে আটক চার লাখ বাঙালিকে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে এক করে দেখছেন। বাঙালিরা পাকিস্তানে শুধুমাত্র চাকরি করছে। তারা নির্দোষ, নিরপরাধ। বাংলাদেশে জঘন্যতম অপরাধ করার দায়ে অপরাধী যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে কোনওভাবেই আটক বাঙালিদের এক করে দেখা যেতে পারে না।
ভুট্টোকে উপদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, যুদ্ধাপরাধীরা পশুরও অধম। এদের ফিরিয়ে নিতে চাইবেন না। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের বিচার করা হবে। তবে নির্দোষদের ফেরত দেওয়া হবে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ভুট্টো সাহেব তার খাঁচায় শেখ মুজিবকে আটকে রাখতে পারেননি। বাঙালিদের তিনি আটকে রাখতে পারবেন না। তাদের ছেড়ে দিতেই হবে। তাদের ফেরত দিতে বাধ্য হবে।
১০ মে পাবনার ছবি ১২ ম ‘র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়
শ্রমিক-কৃষক রাজ
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, শ্রমিক-কৃষক রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, দেশের সমস্ত সম্পদের মালিক এখন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। গণতন্ত্রের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন গণতন্ত্রের অর্থ যা খুশি তাই করা নয়। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধবাদীদের তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আহ্বান করে বঙ্গবন্ধু জানান, তিনি যেকোনও সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত আছেন।
রংপুর দৈনিক বাংলার বিশেষ প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদে বলা হয়, সেখানে ময়দানে অনুষ্ঠিত এই জনসভা ছিল রংপুর জেলার ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভা। গৃহসংস্থান মন্ত্রী মতিউর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন।
রুটিন সময়ের বাইরে কাজের আহ্বান
সভায় ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, উৎপাদন বৃদ্ধি না হলে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম হতে পারবে না। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারীদের রুটিনমাফিক সময়ের বাইরে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের কলকারখানার উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষকদের দ্বিগুণ উৎসাহে ফসল উৎপাদন করতে হবে। আর সকলের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা যাবে।
১১ মে রংপুরের সমাবেশের ছবি ১৩ মে’র পত্রিকায় প্রকাশিত
শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে
বঙ্গবন্ধু বলেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা না হলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না। এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু বলেন ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও নিরস্ত্র হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী দালালরা বিদেশি অর্থ নিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে চলেছে। এইসব দালাল বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায়। তিনি বলেন, জনগণের একতায় তারা বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় কিন্তু বিভেদ সৃষ্টির করার প্রচেষ্টায় জনগণ বরদাস্ত করবে না। তিনি বলেন, কিছু লোক বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ফাটল ধরাতে চেষ্টা করছে। জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আপনারা সতর্ক থাকবেন। এসব মিত্রদেশ আমাদের চরম বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিল।
এর আগে বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টারে করে রংপুর পুলিশ লাইনে অবতরণ করলে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। তিন লাখ উৎসুক জনতা বঙ্গবন্ধুকে দেখে আনন্দ স্লোগান দিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাইফেলের গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলে গণপূর্তমন্ত্রী মতিউর রহমান তাকে প্রথম সম্বর্ধনা জানান।
এক নজর দেখার জন্য
কালেক্টরেট ময়দানে ভাষণ শোনার পরও সমবেত জনতার মধ্য হতে শত শত লোক তাদের মুজিব ভাইকে একনজর দেখার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ তারা আগে তার ভাষণ শুনলেও মুখ দেখতে পারেনি। এক নজর দেখতে ও তার বক্তব্য শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ বাসে, ট্রেনে ও অন্যান্য উপায়ে শহরে এসে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য এক স্কুলছাত্র পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে লোহার ব্যারিকেড লাফ দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেয় ৬টি ফুল, আলিঙ্গন করে চুমু খায়, অতঃপর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরে এলে ছাত্রটি জানায়, বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার আনন্দে এমন হয়েছে।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মে ১১, ২০২০