‘সঞ্চয়িতা’ ও বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশকিছু অমর বাণী বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের পাথেয় ছিল। কারাগারে যাওয়ার সময় তিনি এক কপি সঞ্চয়িতা সঙ্গে করে নিতেন বলে সেটির গায়ে ছিল সেন্সরের অনেক সিল। স্বাধীন বাংলার মাটিতে রবি ঠাকুরের প্রথম জন্মোৎসবকালে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এ কথা জানিয়েছিলেন বলে ১৯৭২ সালের ৮ মে’র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে এদিন বঙ্গবন্ধু বাণী দিয়েছিলেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনন্য এক আদর্শ ছিলেন। সংগ্রামী জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথের প্রতিপদে যখন ছিল পাকিস্তানি শাসকদের হিংস্র অত্যাচার, যখন দুঃশাসনে কারাগারের লৌহ প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর হাতছানি তার জীবনকে যন্ত্রণায় বেঁধে ফেলতো, তখন বেদনার মুহূর্তগুলোতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর বাণী বঙ্গবন্ধুকে সান্ত্বনা দিতো বলে উল্লেখ করেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তঃস্থলে। রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন ও দুঃখ-দৈন্য সব মুহূর্তে তাকে দেখতাম, বিশ্ব বাণী আবৃত্তি করতেন— বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে যেন না করি আমি ভয়। কিংবা যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। প্রভৃতি অসংখ্য গানের টুকরো তিনি আবৃত্তি করে যেতেন— দুঃখ, দৈন্য আর হতাশায় ভরা অতীতের সেই দিনগুলোতে।’
 
বেগম মুজিবের স্মৃতি চারণের বরাতে দৈনিক বাংলা পত্রিকা লিখেছে— ‘সময় সময় আমার মনে হতো তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে আবেগময় আবৃত্তি, যেন তার জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে এক হয়ে মিশে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় আছে কবিগুরুর প্রভাব। পাকিস্তানের কবলে নিক্ষেপিত বাঙালি অন্তরকে বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের সঞ্জীবনী সুধায় উজ্জীবিত করেছেন।’ ‘‘কবি গুরুর প্রার্থনা ছিল— ‘বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পূণ্য হউক পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।’ বিশ্বকবির প্রার্থনাকে বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।’’

‘কবিগুরুর সোনার বাংলাকে পবিত্রতায়, স্নিগ্ধতায় অপরূপ করে তোলা বঙ্গবন্ধুর জীবনের পরম প্রার্থনা। আর এই জন্যই তিনি নেমেছিলেন সংগ্রামে। আর তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিল কবিগুরুর বাণী। সে সময় বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়িতা হাতে তুলে নিতেন। কারাগারে নিঃসঙ্গতায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল সঞ্চয়িতা। বইয়ের গায়ে পড়েছিল জেলের সেন্সরের অনেকগুলো চিহ্ন। অনেক যত্নে রাখা সত্ত্বেও সঞ্চয়িতার কবিতা বহু ব্যবহারে পুরাতন হয়ে গিয়েছিল। কারাগারের মুহূর্তগুলোতে বঙ্গবন্ধু পড়াশোনা করতেন একাগ্রচিত্তে। রচনা সম্ভার ছাড়াও দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত বইয়ের নাম আছে তাঁর তালিকায়। জেলের ভেতরে বসেই তিনি এসব বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করতেন। আমাকে সেগুলো সংগ্রহ করতে হতো’, বলেন বেগম মুজিব।

  
বঙ্গবন্ধুর ওপর রবি ঠাকুর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে বলতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য  বেগম মুজিবকে চঞ্চল দেখিয়েছিল বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, লাজুক কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘কোনও কারণে আমি মনঃক্ষুণ্ণ হলে অতীতে বঙ্গবন্ধু আমাকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। আজও  শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে তিনি কাব্য আলোচনা করেন। আবৃত্তি শোনান পরিবারের লোকদের। রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকীর সময় একবার একজন বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে আমি রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরো এক সেট কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। ওর সামনে যখন উপহার হিসেবে বইগুলো উপস্থিত করলাম, খুশির আবেগে তিনি তখন বিহ্বল হয়ে পড়লেন। উজ্জ্বল চোখ দুটো তুলে একবার শুধু তাকালেন। সে চোখে ছিল শিশুর মতো।’

রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তির প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যে বাণী দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেন, ‘রক্ত দিয়ে আমরা রবীন্দ্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। বাঙালি আপন  বুকের রক্ত দিয়ে তার রবীন্দ্র অধিকার বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছে।’ ৭ মে বাংলা অ্যাকাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রীতি ও শুভেচ্ছা বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও  বলেন, ‘সত্য-ন্যায়ের যে চেতনা বাঙালি কবি গুরুর কাছ থেকে লাভ করেছে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি।’ তাঁর বাণীর পূর্ণ বিবরণ— ‘নতুন পরিবেশ নতুন চেতনায় এবার স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য-ন্যায়ের যে চেতনা বাঙালি কবি গুরুর কাছ থেকে লাভ করেছে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ  স্বার্থক হয়েছে। বাঙালি তার বুকের রক্ত দিয়ে তার রবীন্দ্র অধিকার বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। রবীন্দ্র সম্মাননার এর চেয়ে বড় কোনও দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মে ০৭, ২০২০ 

SUMMARY

2648-১.jpg