বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঘৃণ্য সেনা অভিযানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গ্রেপ্তারের আগেই, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
 
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় যে শিশুটি জন্মেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তিনিই হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।

বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব   '৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশনে 'ছয় দফা' উত্থাপন করেন। দাবিটি তিনি বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জানান। পরিণতিতে কনভেনশন বর্জন করেন শেখ মুজিব।

রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে তার। তারপর নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। নিজেকে পরিণত করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তরাণ্বিত করেছে যে ঘটনাগুলো, তার অন্যতম '৬ দফা' আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু ওই ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে দেশব্যাপী একের পর এক জনসভা করেন। এরই অংশ হিসেবে ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় তিনি ছয় দফাকে 'নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ' অভিহিত করেন।

সেদিন ভাষণে তিনি বলেন, 'একদিন ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্তি শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলার বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসী চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।'

এরপর একে একে ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদি ও বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর এবং ১৪ মার্চ সিলেটে তিনি জনগণের সামনে ৬ দফা তুলে ধরেন।

'আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি' শীর্ষক একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু। ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি বলেন, 'কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তিসনদ।' 

৬ দফা ঠেকাতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাকে জনগণমন অধিনায়কে পরিণত করে। 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' বলে খ্যাত 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য' মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলাতে চেয়েছিল শাসকেরা। তবু তিনি অনড় থেকেছেন; বিন্দুমাত্র আপস করেননি। ফিরে এসেছেন জনতার কাতারে। 'শেখ মুজিব' থেকে হয়ে উঠেছেন 'বঙ্গবন্ধু'।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তনি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। উল্টো আঁকতে থাকে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আপসহীন নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সামনে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...।' ঐতিহাসিক সেই ভাষণে তিনি বাঙালিদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানান।

২৫ মার্চ কালরাতে ঘৃণ্য সেনা অভিযানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গ্রেপ্তারের আগেই, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সেই ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশে-বিদেশে।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি কারাবন্দি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। যেকোনো মুহূর্তেই তাকে মেরে ফেলা হবে- এমন আশঙ্কায় ছিল পুরো জাতি; তবু তিনি পরোয়া করেননি। তার প্রেরণা, তার নির্দেশনা মেনে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে শেষ হাসি হেসেছিল বীর বাঙালি। বাংলাদেশ পেয়েছে স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাই অবিচ্ছেদ্য।

SUMMARY

2642-1.jpg