আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’
১৯৩৮ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। শহরে আসবেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির দায়িত্ব পড়ল কিশোর শেখ মুজিবের ওপর। সভা শেষে সোহরাওয়ার্দী গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। স্কুলের ছাত্রদের পক্ষে তাকে সংবর্ধনার নেতৃত্বের ভার বঙ্গবন্ধুর কাঁধে। স্কুল থেকে সোহরাওয়ার্দী যখন ফিরছিলেন, হাঁটতে হাঁটতে তাকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনই প্রিয় গুরুর সঙ্গে প্রথম আলাপ কিশোর মুজিবের।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন সোহরাওয়ার্দী। নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন। পরে একটা ধন্যবাদ চিঠিও পাঠান। আরও বললেন, বঙ্গবন্ধু যেন কলকাতায় গেলে তার সঙ্গে দেখা করতে।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় গেলেন, সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির দারোয়ান প্রথমে তাকে ঢুকতে দিতে চাননি। সোহরাওয়ার্দী তখনো মন্ত্রী। তার দেওয়া কার্ডটি দারোয়ানকে দেখালেন শেখ মুজিব। কার্ড দেখে তাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী বললেন, 'ম্যাট্রিক তো পাস করে ফেলেছ, এখানেই কলেজে ভর্তি হও। আমার সঙ্গেও কাজ করো।' এভাবেই বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক শাখায়।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন 'আজাদ' পত্রিকার মালিক মওলানা আকরম খাঁ। অন্যদিকে সেক্রেটারি ছিলেন বর্ধমানের আবুল হাশিম। মতবিরোধের কারণে ওই সময় মুসলিম লীগ দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন উর্দুভাষী খাজা নাজিমুদ্দীন ও মওলানা আকরম খাঁ। তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা লিয়াকত আলীর যেকোনো সিদ্ধান্তেই সমর্থন দিতেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে চলতে থাকে প্রগতিশীল গ্রুপ।
মুসলিম লীগ ভাগ হওয়ায় ছাত্রলীগও বিভক্ত হয়ে যায়। নাজিমুদ্দীন সমর্থিত গ্রুপটির নেতৃত্ব দেন শাহ আজিজুর রহমান। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপকে সমর্থন দিতে থাকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ স্নেহ করতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এর একটি প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর প্রথম লাহোর সফর। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী পার্টি গঠন বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করতে তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু লাহোর পৌঁছে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন, সোহরাওয়ার্দী সেখানে নেই। তখন শীতকাল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর কাছে শীতের কাপড়ও নেই। তিনি উপায় না দেখে পূর্বপরিচিত মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের বাড়িতে ওঠেন।
সোহরাওয়ার্দী লাহোর ফিরলেন বঙ্গবন্ধু যাওয়ার দুইদিন পর। তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন সোহরাওয়ার্দী। খোঁজখবর নিলেন। তারপর একান্তে কথা বললেন স্নেহের শিষ্যের সঙ্গে। তার থাকার জন্য নিজে হোটেল ঠিক করে দিলেন। দোকানে নিয়ে জামা-কাপড় কিনে দিলেন। সেবার লাহোরে থাকার দিনগুলোতে সকালে সোহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে রাতে ফিরতেন বঙ্গবন্ধু। সারাদিন আলাপ চলত দুজনের।
নির্বাচনী প্রচারণায় রাজশাহীতে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু
প্রিয় এই মানুষের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'জীবনের বহুদিন তার সাথে সাথে ঘুরছি। তার স্নেহ পেয়েছি এবং তার নেতৃত্বে বাংলার লোক পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যার একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না, আজ তার কিছুই নাই। মামলা না করলে তার খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি! তার সহকর্মীরা- যারা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করত, তারা আজ তাকে শত্রু ভাবছে। কত দিনে আবার দেখা হয় কী করে বলব? তবে একটা ভরসা নিয়ে চলেছি, নেতার নেতৃত্ব আবার পাব। তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্য করবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিম লীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহায্য করেন। তার সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে।'
সোহরাওয়ার্দীও স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধুকে তারকা সংগঠক আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন রাজনীতির উত্তপ্ত মাঠের দুর্বার কর্মী। স্নেহের মুজিবের জন্য অনেক করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে তিনি যখন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় অংশ নিতে ঢাকায় আসেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব সে-ই কাচা হিরের টুকরা, যাকে সামান্য দিকনির্দেশ দিতে পারলেই পূর্ব বাংলা তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ নেতা পাবে।
ওই বছরই তার প্রস্তাব অনুসারে পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে জ্ঞান বাড়াতে বঙ্গবন্ধুকে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে শিক্ষা সফরে পাঠায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি। দুই মাসের সেই ট্যুরে তিনি সবচেয়ে বেশি সময়, ১২ দিন কাটিয়েছিলেন লন্ডনে।
বঙ্গবন্ধুর সংসারের আয়-রোজগার নিয়েও ভাবতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাই ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান চা বোর্ডের সভাপতি করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে থাকেন। তাই উপার্জনের এমন একটা রাস্তা তাকে সোহরাওয়ার্দী জুটিয়ে দিয়েছিলেন, যে পদটি আলংকারিক; আক্ষরিক অর্থে যেখানে খুব একটা সময় দেওয়ার বালাই ছিল না।
প্রিয় গুরুর জীবনেও বঙ্গবন্ধুর অনেক অবদান। ভাষা আন্দোলন, দলের নাম বদলসহ বিচিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতবিরোধ হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত শিষ্যের বিচক্ষণ যুক্তি মেনে নিয়েছেন গুরু। এই যেমন, ভাষা আন্দোলনে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আনতে করাচি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন 'নাছোড়বান্দা' বঙ্গবন্ধু। আবার ১৯৫৫ সালে দকলে অসাম্প্রদায়িক করতে 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিতে রাজি করিয়েছেন।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।'