সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও বাঙালির হাতে ন্যায্য রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। প্রতিবাদে ফেটে ওঠে বাঙালি জনতা।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতেই জয়ী হয় দলটি। এই নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার ঘোষণা দেন।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকিস্তানের সামরিক শক্তি আওয়ামী লীগের হাতে ন্যায্য রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
১ মার্চ ১৯৭১
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির এদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সমগ্র জাতি উৎসুক হয়ে চোখ-কান খোলা রেখেছিল টিভি ও রেডিওর দিকে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের বদলে আরেকজন মুখপাত্র ঘোষণা দিলেন: 'প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান এখন গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে।'
এই ঘোষণা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। তিনি বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দেন। সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নয়, বরং পাকিস্তানি শাসকরা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি ২ ও ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন। পরবর্তীকালে বাঙালিরা প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্লোগান দিতে থাকে: 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' প্রভৃতি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
২ মার্চ ১৯৭১
এক দিকে হরতাল, মিছিল আর অন্যদিকে কারফিউ, সব মিলিয়ে ঢাকা শহর চরম উত্তপ্ত ছিল এ দিন।
ভোর থেকেই মিছিলের পর মিছিল নিয়ে মুক্তিকামী মানুষেরা জড়ো হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের এ রকম সমাবেশ এর আগে আর দেখা যায়নি। নিউ মার্কেট থেকে নীলক্ষেত হয়ে পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় ভীড়।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। লাঠি ও রড হাতে সারা ঢাকায় চলতে থাকে বিশাল মিছিল।
এ দিন এই ভূখণ্ডের বাঙালিদের অভিধান থেকে 'পাকিস্তান' শব্দটি মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বারবার জোর দিয়ে 'বাংলাদেশ' উচ্চারণ করতে থাকেন।
সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডারা আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করে। আহত অন্তত ৫০ জনকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তেজগাঁও পলি টেকনিক কলেজের ছাত্র আজিদ মোরশেদ ও মামুন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর মারা যান।
পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করে সামরিক সরকার। নিরীহ মানুষকে হতাহত করায় বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যার সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন তিনি। পরের দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সভা শেষে পল্টনে র্যালি করার কর্মসূচী ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
৩ মার্চ ১৯৭১
নিহতদের স্মরণে শোক দিবস পালন করা হয়। ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগের সঙ্গে সভায়, প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমি থাকি কিংবা না থাকি, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম থামবে না। বাঙালির রক্ত বৃথা যাবে না। আমি না থাকলে, আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দেবে। যদি তাদেরও মেরে ফেলা হয়, তাহলে যারা বেঁচে থাকবে, তারা নেতৃত্ব দেবে। যেকোনো মূল্যেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু জানান, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন।
৪ মার্চ ১৯৭১
কারফিউ ভেঙ্গে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশ। স্বাধীনতার স্বপ্ন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
খুলনায় বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। লাগাতার হরতাল ও ধর্মঘটে পুরো জাতি একাট্টা হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেন।
'রেডিও পাকিস্তান ঢাকা'র নাম বদলে 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র' রাখা হয়।
৬ মার্চ ১৯৭১
জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। শাসকদের পক্ষে ঘোষণা করা হয়, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ, ঢাকায়।
এ রকম পরিস্থিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তান মিলিটারির সদস্যরা ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করার জন্য বিভিন্ন রকমের বার্তা বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ৭ মার্চের র্যালি মাথায় রেখে রাস্তায় সামরিক ট্যাঙ্ক প্রস্তুত রাখে পাকিস্তানি শাসকরা। মেজর সিদ্দিক সাদিক তার বইয়ে লিখেছেন, এদিন বঙ্গবন্ধুকে ইস্ট পাকিস্তানের জিওসি স্পষ্টই হুমকি দিয়েছিলেন, 'পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যদি কিছু বলা হয়, সামরিক বাহিনী কঠোর জবাব দেবে। দেশদ্রোহীদের (বাঙালিদের) উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান- সব প্রস্তুত আছে। দরকার হলে পুরো ঢাকা শহরকে ধূলিতে মিশিয়ে দেওয়া হবে।'
৭ মার্চ ১৯৭১
রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাকাব্যিক সেই ভাষণটি দেন, 'এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম'।