কীর্তিতেই তুমি মহীয়ান

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী 

যে কোনো মুহূর্তে আবারো ছোবল দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, মাঝেমধ্যে সেই আওয়াজও তাদের কেউ কেউ দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখন যারা মুজিব শতবছরে নানা আয়োজনে মুজিবকে স্মরণ করছেন তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে আরো বেশি নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। ইতিহাসের শক্তিতে পরিণত হওয়ার ইতিহাসটি তুলে ধরা। তাহলেই মুজিব দ্বিশতজন্মবর্ষে আরো গভীরভাবে মানুষের কাছে আপন হয়ে ধরা দেবেন।

গতকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হযেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে শতবর্ষের আয়োজন কিছুটা সীমিত আকারে পালিত হচ্ছে। তারপরও জন্মশতবর্ষ যেহেতু আর ফিরে আসবে না, আর একশ বছর পরে দ্বিশতবর্ষ পালনের বিষয়টি আসবে। তখন এই সময়ের কেউই হয়তো বেঁচে থাকবে না, ভিন্ন বাস্তবতায় দ্বিশতবর্ষের বিষয়টি আসবে। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন নিয়ে শতবর্ষের চিন্তাটি একেবারেই কোনো কাল্পনিক চিন্তা নয়। কেননা তিনি এমনই একজন রাজনীতিবিদ যিনি তাঁর আপন কীর্তিতেই শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণের কাছে মহীয়ান নন। বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে তিনি স্মরণীয়-বরণীয় একজন বিশ শতকের সাড়া জাগানো নেতা। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জন্মদিন পালনে শতবর্ষের বিষয়টি ইতিহাসের মহান কীর্তির কারণেই এতটা প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধু ১৯২০ সালের এই দিনে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চার বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মা আদর করে তাকে খোকা বলে ডাকতেন। টুঙ্গিপাড়ার এই খোকা শৈশব-কৈশোরে অনেকের চেয়ে সাহস ও দুরন্তপনায় আলাদা ছিলেন। যত বেড়ে উঠেছেন তত তিনি ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হয়ে ওঠার সময়টি ছিল ইতিহাসের এক বহু রাজনৈতিক ঘটনায় মানুষকে উদ্বেলিত, উজ্জীবিত এবং দেশ ও মানুষের স্বাধীনতার আন্দোলনে সিক্ত হওয়ার সময়। তরুণ শেখ মুজিব তাতে সিক্ত ও সমৃদ্ধ হলেন। চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে হৃদ্ধ হলেন রাজনীতিতে। দীক্ষা নিলেন মানুষের মুক্তি ও কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হলেন, স্বপ্নও দেখেছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের। কিন্তু দেশ বিভাগের আনন্দ খুব দ্রুতই উবে গেল। বুঝতে পারলেন যে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন প্রাপ্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনে তা দেবে না। সুতরাং ঘুরে দাঁড়ালেন তরুণ এই শেখ মুজিব।

মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকায় তিনি একজন তরুণ সাহসী ও প্রতিশ্রুতিশীল নেতা হিসেবে অগ্রজদের কাছে সমাদৃত হলেন। সে কারণেই জেলে বন্দি থাকা তরুণ নেতা শেখ মুজিব ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। এই রাজনৈতিক দল ক্রমেই তার হয়ে উঠল। তিনি এই রাজনৈতিক দলটিকে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র দান থেকে দ্রুতই স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জনগণের প্রধান দলে পরিণত করলেন। যেসব রাজনৈতিক নেতারা দল গঠনে ১৯৪৯ সালে যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই দল ছেড়ে নতুন দল করলেন, আবার অনেকেই বয়স ও মৃত্যুজনিত কারণে ছিলেন না। কিন্তু শেখ মুজিব এই দলটিকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে পূর্ব বাংলাকে স্বাতন্ত্রিক মর্যাদা দানের এক নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন সূচনাকারী শক্তিতে রূপান্তরিত করলেন। এটি ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলনে পরিচিত হলো। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে এবং শেখ মুজিবকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রকারী বা শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। শেখ মুজিব পাকিস্তান রাষ্ট্রের এমন অবস্থার বিপরীতে একজন রাজনীতির সৃষ্টিশীল নেতা হিসেবে নিজের ও দলের অবস্থানকে তুলে ধরলেন। শত শত নেতাকর্মী জেলে গেলেন। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলন পরিত্যাজ্য হলো না। বরং সেটি আরো মানুষের কাছে সমর্থিত হতে থাকল। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা আরো বেশি পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলনকে দমন নিষ্পেষণের মাধ্যমে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে রাজনীতির এই অদম্য সাহসী ছয় দফা প্রণেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। ততদিনে অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতাই এমন আন্দোলন ও দাবিনামা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জনগণের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব বাংলাবিরোধী আচরণের প্রকাশ ঘটায়। সেখান থেকেই তরুণ ছাত্র সংগঠনগুলো ছয় দফার সঙ্গে ১১ দফা মিলিয়ে আন্দোলনে শামিল হলো। যে ছয় দফাই পাকিস্তান সরকার হজম করতে চাইছিল না। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে বাড়তি ১১ দফা যুক্ত হয়ে পাকিস্তানকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল। শুরু হলো পাকিস্তান সরকারের আন্দোলন দমনের একের পর এক পর্ব, এর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঐক্য প্রদেশব্যাপী প্রতিদিন যেন বড় হতে থাকল। মৃত্যুর মিছিল যত বাড়ছিল আন্দোলন তত জঙ্গিত্ব রূপ লাভ করছিল। সৃষ্টি হলো গণঅভ্যুত্থান। এমন অভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা আইয়ুব খান কিংবা তার পুলিশ সেনাবাহিনী কারোই আর রইল না। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানকে আত্মসমর্পণ করতে হলো পূর্ব বাংলার গণঅভ্যুত্থানের কাছে, প্রত্যাহার করে নিতে হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, মুক্তি দিতে হলো শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে। শেখ মুজিব এ সময়ে রাজনীতির বিজয়ী বীর হিসেবে ছয় দফার মালা বুকে নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে এলেন, গণসংবর্ধনায় তিনি ভ‚ষিত হলেন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। গোপালগঞ্জের সেই ছোট্ট খোকা আর খোকা রইল না। তরুণ শেখ মুজিব আর তরুণ রইল না। তিনি রাজনীতিকে ভাঙলেন, গড়লেন সঙ্গে নিলেন পূর্ব বাংলার জনগণকে। জনগণ তার রাজনীতিতে প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত হলো। ফলে কারাগারে তাকে আর বন্দি করে রাখা গেল না। বের হয়ে এলেন তিনি বাংলার প্রিয় নেতা হিসেবে, একশব্দে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। শেখ মুজিবের ধাপে ধাপে উত্তরণের এমন উচ্চতাটি নির্মিত হয়েছিল তার অদম্য রাজনৈতিক স্পৃহা, সাহস, কর্মসূচি এবং জনগণকে একাত্ম করার চেতনাবোধে। এরপরও তিনি থেমে থাকেননি পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে তিনি সাধারণ নির্বাচন আদায় করে নিলেন।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে হলেন অবিসংবাদিত নেতা। নেতৃত্বের এমন উচ্চতায় তিনি উঠলেও তিনি ছিলেন মাঠের অতি সাধারণ মানুষের অতি আপন নেতা। সে কারণে তাঁর উত্তরণটি ইতিহাসের এক মহীমান্বিত রাজনৈতিক অবস্থান যেটি পূর্ব বাংলাকে দ্রুতই পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে স্বাতন্ত্রিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছিল। এই করাটি কিছুতেই সম্ভব হতো না যদি ১৯৪৭ উত্তর থেকে মুজিবের মতো অবিচল থাকা, নিষ্ঠাবান নেতার অবস্থান এই দীর্ঘ সময়ে জনগণের পাশে না থাকত। অন্যসব নেতা দোলাচলে দুলেছেন। কিন্তু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের জাতিগত নানা জরুরি প্রশ্নে দৃঢ়ভাবে কর্মসূচি প্রদান ও আন্দোলন সংগঠিত করেছেন, জনগণকে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন অতি সহজেই বুঝাতে পেরেছেন, জনগণ এই দর্শনকে নিজেদের করে নিয়েছেন। এখানে জনগণ এবং শেখ মুজিব একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ থাকে তাদের প্রধান নেতা হিসেবে রায় দিয়েছিল। সেই অধিকারেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের সব ষড়যন্ত্র ভেদ করে ৭ মার্চ জনগণের আকাক্সক্ষার স্বাধীনতা লাভের পথ দেখিয়ে দিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থা শেখ মুজিবের রাজনীতিকে বুঝতে অক্ষম ছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানকে বুঝে সেটিকে চিরবিদায় দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। শেখ মুজিব তখন তাদের স্বাধীনতার প্রধান নেতা হিসেবে আবিভর্‚ত হলেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা মনে করেছিল এই প্রধান নেতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে জেলখানায় বন্দি করে রাখলেই স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যাবে। গণহত্যা পরিচালনা করে পাকিস্তান মনে করেছিল পূর্ব বাংলার মানুষকে তারা পদানত করতে পারবে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে শেখ মুজিবের ছিল দুটি বিশেষ ক্ষমতা। এক. তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য যোগ্য ছিলেন। প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন মুজিবনেতা। দুই. মুজিবের ছিল এক জনআত্মার সম্পর্ক। যা তাকে জনগণের প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে দিয়েছিল। মুজিব নামে লাখ লাখ মানুষ স্বাধীনতার জন্য তখন প্রাণ উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। পাকিস্তানিরা মুজিব সত্তার এই দুই রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিল না। ৯ মাসের যুদ্ধে মুজিবের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়ার রাজনৈতিক শক্তি দেশেও প্রবাসে দাঁড়িয়ে গেল। আবার দেশে ও প্রবাসে মুজিবের নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার যুদ্ধারা অস্ত্র হাতে তুলে নিল। সংঘটিত হলো এমনই এক মুক্তিযুদ্ধ, জনযুদ্ধ যেটিকে পরাস্ত করার ক্ষমতা পাকিস্তানের বর্বর পাক জান্তাদের ছিল না। তারা পরাজিত হলো, আত্মসমর্পণ করল, মাথা নিচু করে বাংলাদেশ থেকে বন্দি হিসেবে নিজ দেশে যেতে বাধ্য হলো। এমন রাজনৈতিক ক্যারেজমেটিক নেতৃত্ব পৃথিবী খুব কমই দেখেছে। বঙ্গবন্ধু সেই রাজনৈতিক নেতার আসনে থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি রাজা ছিলেন না, হলেন জনগণের বিশ্বস্ত এক মহান নেতা। যাকে কেন্দ্র করে তখন শুধু রাজনৈতিক আবেগই তৈরি হয়নি, মানবিক সব আবেদন তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে কারণে শিল্পীরা তাকে নিয়ে গান রচনা করেছেন, গেয়েছেন, কবিরা কবিতা লিখেছেন, সাধারণ মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেছেন তার জন্য, মসজিদ-মন্দিরে প্রার্থনায় তার মুক্তি চেয়েছেন। এমন অবস্থানে আর কোনো নেতা কি জগৎব্যাপী হতে পেরেছিলেন? তাঁর কীর্তি তাকে এতটা মহীয়ান করেছে। তাঁর কীর্তির কাছে পরাজিত হয়েছে পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতা, জয়লাভ করেছে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের বাংলাদেশ।

বাঙালি তো স্বাধীনতা চেয়েছিল অনেক আগেই। সোয়া ২০০ বছর একবার দিল্লি থেকে স্বাধীন সুলতানী যুগ নামে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু আকবর সেই বাংলাকে দখল করে দিল্লির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে মোগল গেল, ইংরেজরা এলো বাংলার স্বাধীনতা দূরেই থেকে গেল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা চেয়েও বাঙালিরা প্রতারিত হলো। এই প্রতারণার বিষয়টি একটি গোষ্ঠী বুঝলেও কীভাবে তা থেকে রাজনৈতিকভাবে বের হয়ে আসা যাবে, রাজনীতির সেই দীক্ষা পাঠ, আন্দোলন, মিশন-ভিশন তাদের জানা ছিল না। আরেকটি পক্ষ পাকিস্তানের প্রতি এতটাই অন্ধ ছিল যেন পাকিস্তান ভেঙে গেলে এই জাতির সর্বনাশ হয়ে যাবে- তেমন মূর্খতা ও অবিমৃশ্যকারিতা নিয়েই রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেদের জাহির করেছিলেন। কিন্তু এরা যে জনগণের রাজনীতিবিদ নন, সেটি রাজনীতির সুশিক্ষা যাদের আছে তারাই কেবল নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু যাদের চোখ ও মস্তিষ্ক দুটি অন্ধ প্রলেপে মোড়ানো ছিল তাদের পক্ষে দেখা বা বুঝার কোনো কারণই ছিল না। সেটি তারা শেষ পর্যন্ত দেখিয়েছিল, এখনো তাদের প্রেতাত্মাদের কেউ কেউ ধারণ ও বহন করে। অন্যদিকে যারা পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা স্বীকার করতেন, এমনকি কল্পনাও করতেন কিন্তু তাদের প্রায় সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে কীভাবে বের হওয়া যাবে, কী করতে হবে, রাজনীতির কর্মসূচিগুলো কী কী হওয়া দরকার সেখানেই অনেকেই দুলাচলে দুলছিলেন, সীমাবদ্ধ ছিলেন, আন্তর্জাতিক নানা হঠকারী রাজনীতিতে পাকিস্তানের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পূর্ব বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য ভাষা সংস্কৃতির জাতিগত প্রশ্নে গণজাগরণ গড়ে তুলতে চাইলেন। ১৯৫৪ পরবর্তী সময়ে ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে পূর্ব বাংলাকে অধিকারহীন থেকে অধিকার প্রদানের রাজনৈতিক স্বীকৃত ব্যবস্থা প্রবর্তনের পথে অগ্রসর হলেন। সেখান থেকে তার সঙ্গে মোড়ল পাকিস্তান রাষ্ট্রের দ্ব›দ্ব। যে দ্ব›দ্ব নিরসনের পথে পাকিস্তান হাঁটার রাষ্ট্র ছিল না, মুজিবও পিছু হটার পাত্র ছিলেন না। অনিবার্য সংঘাত মুজিবকে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার পথ সৃষ্টি করবে। সেই পথেই তিনি ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রদানের মাধ্যমে হাঁটলেন, এর জন্য কারাভোগ থেকে সব ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন বরণ করে জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাশক্তিকে নাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নতুনভাবে উত্থানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। সেখানে থেকে তাকে আর পেছনে টেনে নেয়ার কোনো ক্ষমতা পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি প্রমাণ করলেন তিনিই পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। সুতরাং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাঁর আর পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ ছিল না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাজনীতির এই পাঠটি নিতে চায়নি। মুজিব সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে না গিয়ে দৃঢ়ভাবে সম্মুখে যাত্রা করলেন। জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁর শরীর এবং আবেগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল। এরপর মুজিব মানুষের কাছে স্বাধীনতার মূল প্রেরণার নেতা হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মানচিত্রের কাছে অর্পণ করে দিলেন। এখানেই তিনি তাঁর কীর্তিতে মহীয়ান হলেন। যা এই পূর্ব বাংলার অন্য কোনো নেতার রাজনীতির ইতিহাসে ছিল না। এখানেই তিনি আলাদা। এখানেই তিনি ইতিহাসের নির্মাতা। এখানেই তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার জনক।

স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ার কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন। কাঠামোগুলো একে একে তৈরি ও শুরু করেছিলেন। দেশি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী সেই রাষ্ট্রটি পছন্দ করছিল না। সুতরাং তারা ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটলেন। ১৫ আগস্ট শুধু মুজিবকেই নয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেও হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখলকারীদের কাছে মুজিব আতঙ্কের এক শক্তিশালী নাম ছিল, সে কারণে তাকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ২১ বছর তাঁর নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে উচ্চারিত না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এবং আছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। সে কারণে একশ বছর পূর্তিতে মুজিব সশরীরে না থাকলেও আছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিশ্বাসী মানুষের অন্তরে ও প্রেরণায়। তবে মুজিব পাকিস্তানকালে কিংবা স্বাধীনতার সময়ে যাদের দৃষ্টিতে অপছন্দের ছিলেন তারাই তাকে ২১ বছর নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। এখন তারাই মুজিব শতবছরে নিশ্চুপ থেকে জানান দিচ্ছে তারা মুজিব এবং তাঁর অবিচ্ছেদ্য রাজনৈতিক অর্জন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মোটেও শুভানুধায়ী নয় বরং পরাজিত শত্রু। যে কোনো মুহূর্তে আবারো ছোবল দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, মাঝেমধ্যে সেই আওয়াজও তাদের কেউ কেউ দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখন যারা মুজিব শতবছরে নানা আয়োজনে মুজিবকে স্মরণ করছেন তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে আরো বেশি নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। ইতিহাসের শক্তিতে পরিণত হওয়ার ইতিহাসটি তুলে ধরা। তাহলেই মুজিব দ্বিশতজন্মবর্ষে আরো গভীরভাবে মানুষের কাছে আপন হয়ে ধরা দেবেন।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

patwarimamtazuddin@gmail.com

সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০ 

SUMMARY

2631-১.jpg