আমার জন্মদিনই কি মৃত্যুদিনই কি?

১৯৭১-এর ১৭ মার্চ একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মহান মুজিব বলেন- ‘আমার জন্মদিনই কি- মৃত্যুদিনই কি? আমার মানুষকে যখন-তখন গুলি করে মারা হচ্ছে। আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জনগণের সার্বিক মুক্তিই আমার একমাত্র কামনা।’

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি- ইতিহাসের মহানায়ক- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ছিল ১৭ মার্চ। বেঁচে থাকলে এবার শত বছর পূর্ণ হতো এই মহান নেতার। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের এদেশীয় কুলাঙ্গারদের সহযোগিতায় মাত্র ৫৫ বছর বয়সে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মুজিবের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ। আর আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার, স্থপতি এবং মহানায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। বাঙালি জাতি ভাগ্যবান, তাঁরা শৌর্যে বীর্যে চলনে বলনে কথনে সাহসে বলীয়ান অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মুজিবের মতো একজন নেতা পেয়েছিল। একথা সত্য, শেখ মুজিব মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন সব অতিমানবিক গুণাবলি ছিল, যা পৃথিবীর আর কোনো রাজনীতিবিদের মধ্যে ছিল কি-না সন্দেহ। একবার একজন বিদেশী সাংবাদিক এই বাঙালি নেতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার ণ কি?’ মুজিবের ত্বরিৎ জবাব ছিল, ‘ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব.’ ওই সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার দোষ কি?’ ‘ও ষড়াব ঃযবস াবৎু সঁপয’- অতিশয় দ্রুততার সাথে এই জবাব দিতেও দেরি হয়নি তাঁর। সত্যিই তিনি বাংলার মানুষকে বেশি ভালোবেসেছিলেন। এজন্য চরম মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছে।

১৯৬৯-এর ২২ জানুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভ‚ষিত করেন ডাকসুর ভিপি ও সভার সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। সম্ভবত ওই সভাতেই সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা রক্ত দিয়ে ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাকে উদ্ধার করে এনেছেন, আমি আমার রক্ত দিয়ে আপনাদের সেই ঋণ পরিশোধ করব।’ বঙ্গবন্ধু মুজিব বাঙালি জাতির জন্য নিজের রক্ত দেয়ার কথা প্রকাশ্য জনসভায় অনেকবার বলেছেন। জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাঙালি জাতির নেতা রক্ষা করেছিলেন। তাই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোর রাতে একা রক্ত দেননি মুজিব। তাঁর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন পুত্র কামাল, জামাল ও রাসেল, দুই নববিবাহিত পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, ভাগ্নে এশিয়ার প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য, ৪ বছরের সুকান্ত বাবু, কর্নেল জামিল, পুলিশ কর্মকর্তা, গৃহকর্মীসহ বঙ্গবন্ধু নিজে সেই কালরাতে রক্ত দিয়ে বাঙালির রক্তঋণ শোধ করেছিলেন।

কৈশোরেই একজন প্রতিবাদী নেতা হিসেবে আবিভর্‚ত হন মুজিব। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বাংলার বাঘ বলে খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একবার স্কুল পরিদর্শনে গেলে স্কুলের ছাদ নির্মাণের দাবিতে ছাত্রনেতা মুজিব মুখ্যমন্ত্রীর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের দুই

বছর পূর্তির আগেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। কারাগারে থেকে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তরুণ শেখ মুজিব এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। মুজিবের চেয়ে বয়সে এক বছর বড় খন্দকার মোশতাক আহমদ হন দুনম্বর যুগ্ম সম্পাদক। আর তখন থেকেই মুজিবকে ডিঙিয়ে এক নম্বর হওয়ার ক‚টকৌশল শুরু করেন খোন্দকার মোশতাক। কিন্তু মুজিবের জীবদ্দশায় চানক্য খোন্দকারের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট এদেশের কতিপয় নরকের কীট নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করলে কুলাঙ্গার ঘাতকচক্র এবং তাদের দোসর ষড়যন্ত্রকারী বিদেশি মুরব্বিদের মদদে বেইমান মোশতাক অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির গদি দখল করে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর নবাবের গদি দখলকারী মীরজাফর আলী খানের মতো বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর খোন্দকার মোশতাক তিন মাসের বেশি অবৈধ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি।

সংগঠক এবং দূরদর্শী হিসেবেও বঙ্গবন্ধুর কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিব ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বিদেশি লেখকরা পর্যন্ত বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস।’ ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক অসহযোগের দিনগুলোতে একজন নির্বাচিত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল না, তাই তিনি ছাত্রলীগের দ্বারা করিয়েছেন। ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ আয়োজিত লাখো জনতার সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে জাতীয় সংগীত এবং বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ নামটির নামকরণও করেন শেখ মুজিব। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণস্থ তিন নেতার মাজারের পাশে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় শেখ মুজিব বলেন, “এক সময় এ দেশের বুক হতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কিছুতে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।… বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত গণনায়ক শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলার প্রতিও অমার্জনীয় অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়েছে।… বাংলার এই কৃতী দুই সন্তান আজ অসহায়ের মতো আমাদের মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। এই দুই নেতার মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।” (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬.১২.১৯৬৯)।

পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তরুণ শেখ মুজিবের বুঝতে বাকি রইলো না, পূর্ব পাকিস্তান আসলে স্বাধীন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্র এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্বাঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ ছাড়া আর কিছু মনে করছে না। অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মুজিব পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেরও কম বয়সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচারে তরুণ শেখ মুজিব বিশেষ অবদান রাখেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরে যৌবনের এক যুগ তিনি জেলে কাটিয়েছেন। সামরিক আইন, সান্ধ্য আইন, জেল-জুলুম-অত্যাচার, নির্যাতনের মুখে জীবনে কোনোদিন তিনি আত্মগোপন করেননি। কারাগার ছিল মুজিবের দ্বিতীয় বাড়ি। জেলে যাওয়ার জন্য তাঁর একটি ছোট্ট বেডিং সব সময়ই প্রস্তুত থাকত। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেলেও সমমনা যুবকদের নিয়ে মুজিব দলকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মোকাবিলায় শেখ মুজিব ষাটের দশকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিবর্তে সরাসরি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দূরদর্শী মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে বিরোধীদলীয় সমাবেশে যোগদানের পর সেখানে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। মুজিব জানতেন, পাকিস্তানের জান্তা কোনোদিন স্বায়ত্তশাসনের দাবি মানবে না। তিনি এও জানতেন, স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা দাবিই একদিন এক দফায় অর্থাৎ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হবে।

মুজিরের ৬ দফা যে প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে এবং ৬ দফার আড়ালে মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চাইছেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তার এটা বুঝতে বাকি রইল না। ৬ দফা দেয়ার পর সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে উল্লেখ করেন। মুজিব এবং দলের শীর্ষ নেতাসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের কয়েক হাজার নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তিন মাসেরও কম সময়ে মুজিব চারণ কবির মতো বাংলার আনাচে-কানাচে সফর করে ৬ দফাকে পূর্ব বাংলার জনগণের দাবিতে পরিণত করেন। মুজিব ও নেতাকর্মীরা জেলে থাকা অবস্থায় পূর্ব বাংলার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বুঝে গেলেন, মুজিব বেঁচে থাকলে পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যার প্রস্তুতি নেয় জান্তা সরকার। রুখে দাঁড়ালো বাংলার মানুষ। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মুজিবসহ অন্য নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুবের পর নতুন বেশে পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেন জেনারেল ইয়াহিয়া।

আইয়ুবের ফাঁসির মঞ্চ থেকে বেঁচে আসা বাঙালি নেতা মুজিবের তখন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। জে. ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পায় মুজিবের দল। প্রাদেশিক পরিষদে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেল ২৮৮টি। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ মুজিব বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একজন অতিশয় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবিভর্‚ত হলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নিয়ে শুরু করলো ষড়যন্ত্র। ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ১ মার্চ আকস্মিকভাবে স্থগিত করে দেয়া হয়। জান্তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না মুজিবের বাংলা। সারা বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু হলো হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন। একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে পাকিস্তানিদের কামান-বন্দুকের মুখে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কাছে নিজের জীবনকে অতিশয় তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম রেহমান সোবহান এমন একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। ২৫ মার্চ বিকেল ৫টা/৬টার দিকে পাকিস্তানের তারিক আলীর বাবা মাজহার আলী খানকে নিয়ে তিনি ৩২ নম্বর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। রেহমান সোবহান তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের জানালেন, সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবে। ইয়াহিয়া মনে করেছে যে, আমাকে হত্যা করলেই সে আন্দোলন ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু সে ভুল করছে। আমার কবরের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে।’ (ড. রেহমান সোবহানের লেখা বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পৃ. ১০৭) শেখ মুজিব এমনিভাবেই নিজের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রস্তুতি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা গ্রন্থ ‘ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ’সহ বিশ্বের পত্রপত্রিকা এবং বিভিন্ন দেশের বেতার-টিভিতে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেভিড লোসাক তার ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ গ্রন্থে লিখেছেন, “২৫ মার্চ রাত ১২টায় পাকিস্তান রেডিও সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভ লেংনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ঐ কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।” সাংবাদিক মিজানুর রহমান সম্পাদিত ‘১৯৭১- আমেরিকার গোপন দলিল’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ২৭ মার্চ ড. হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠত এক বৈঠকে সিআইএর পরিচালক রিচার্ড হেলমস বলেন, ‘একটি গোপন বেতার প্রচার করেছে যে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’

“বাঙালি জাতির ইতিহাসের নায়ক বঙ্গবন্ধু। এই ইতিহাসে তাঁর স্থান চির অমলিন, অমোঘ। তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের ইতিহাসের রূপকার, বাঙালির দুঃসময়ের কাণ্ডারি এবং ইতিহাসের মহানায়ক। এই স্থানটি শুধু তাঁরই জন্য সংরক্ষিত।”

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কোনো ব্যক্তির একদিনের ঘোষণায় কোনোকালে কোনো দেশ স্বাধীন হয়নি এবং কোনোদিন তা হবেও না। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। মনীষী আবুল ফজল লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব ইয়াহিয়া-টিক্কার জিন্দানখানায় বন্দি থেকেও ৯ মাস সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মরণপণ সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছেন। যে প্রেরণা অজেয় শক্তি হয়ে আমাদের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে স্বাধীনতাকে। অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব সত্যিই অভিনব, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।’

বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্বের জন্য ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী নিউজউইক তাঁকে ‘Poet of politics’ অর্থাৎ ‘রাজনীতির কবি’ বলে উল্লেখ করে। আসলে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের সফল ও সার্থক রচয়িতা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন বিদেশি খ্যাতিমান ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, “প্রায় বারোশ বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পর বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় ও জাতি বিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা।” বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও বাঙালি একে অপরের পরিপূরক। ড. আতিউর রহমান যথার্থই লিখেছেন, “বাংলাদেশের আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান।” অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি উদ্ধৃতি দিয়েই আজকের লেখার ইতি টানতে চাই। তিনি লিখেছেন, “বাঙালি জাতির ইতিহাসের নায়ক বঙ্গবন্ধু। এই ইতিহাসে তাঁর স্থান চির অমলিন, অমোঘ। তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের ইতিহাসের রূপকার, বাঙালির দুঃসময়ের কাণ্ডারি এবং ইতিহাসের মহানায়ক। এই স্থানটি শুধু তাঁরই জন্য সংরক্ষিত।” জন্মদিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের আত্মার আত্মীয় যুগস্রষ্টা মুজিবকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জয় বাংলা। জয়তু শেখ মুজিব।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২০

SUMMARY

2628-১.jpg