১১ জানুয়ারি, ১৯৭২: অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ জারি, সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ

উদিসা ইসলাম
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২’ জারি করা হয়। বলা হয়, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ও মার্চে নির্বাচিত ও অন্য কোনও কারণে অযোগ্য ঘোষিত নয় এরকম সব এমএনএ (মেম্বার অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) ও এমপিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদ গঠিত হবে এবং প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত করবেন। এ আদেশ বাংলাদেশের সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হবে।

এই আদেশ বলে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে সরকার পদ্ধতি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যায় এবং শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরদিন ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

এই রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় সংসদীয় গণতন্ত্রকেই দেখেছেন। সেই জায়গা থেকে তিনি এই উদ্যোগ নেন। তাছাড়া পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের মানুষও লড়াইয়ে বিভিন্ন সময় সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে আসছিল–কেন্দ্রীয় শাসন বা রাষ্ট্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে সংসদীয় গণতন্ত্র চায়। আমার মনে হয় সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে এবং বিশ্বাস থেকেই তিনি সেখানে ফেরত গেছেন।

একদিনও বিশ্রাম নেননি বঙ্গবন্ধু

দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে বিশ্রাম নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্লান্তির মধ্যেই তিনি দেশ গঠন সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তার সহযোদ্ধা রাজনীতিক ও মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করতে থাকেন। তার ওপর সাধারণ জনগণকে একনজর দেখার বিষয় তো ছিলই। এদিন জনতার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু কোনও প্রটোকল নেননি। সেদিন ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের ভাড়া বাসায় যারা গিয়েছেন, তারাই তার দেখা পেয়েছেন। পরিশ্রান্ত নেতা বাসার সামনে জড়ো হওয়া জনতার মধ্যে কয়েক দফা নেমে আসেন। ১২ জানুয়ারির দৈনিক বাংলার সংবাদ বলছে, ১১ জানুয়ারি সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু যান মন্ত্রিসভার বৈঠকে। পৌনে ৩টায় তিনি মিলিত হন শাহবাগ হোটেল কর্মচারীদের সঙ্গে। সাড়ে ৫টায় আবারও বেরিয়ে আসেন তিনি। ততক্ষণে সেখানে ভিড় জমে যায় মানুষের।

  

বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক

১১ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘরোয়া আলোচনায় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা পূরণের ব্যবস্থা সম্পর্কেও আলোচনা হয় বলে দৈনিক বাংলার খবরে জানানো হয়। এনা পরিবেশিত খবরের ভিত্তিতে পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল (১১ জানুয়ারি) সকালে ও রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের অনুষ্ঠিত দুই দফা দীর্ঘ আলোচনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগীরা নীরব থাকেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকালে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার পুরো মন্ত্রিসভার সঙ্গে তিন ঘণ্টাব্যাপী ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দ্বিতীয় দফা বৈঠক শুরু হয় এবং গভীর রাত পর্যন্ত চলে। তবে বৈঠকের আলোচনার সূচি জানা যায়নি।

দেশে ফেরার পরের দিনই সারাদিনই নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে তার দফায় দফায় বৈঠক চলে। এদিনই শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ জারি করা হয়। এর প্রায় দু’মাস পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এই আদেশ ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে ঘোষিত হয়।

রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ বিষয়ে তাজউদ্দীন

দৈনিক বাংলার সংবাদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বরাত দিয়ে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক শপথ গ্রহণের প্রশ্ন ওঠে না। কারণ এই সরকার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (১১ জানুয়ারি, ১৯৭২) ঢাকায় একথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু কী শপথ গ্রহণ করবেন এই জাতীয় এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতাসীন সরকার নয়। এই সরকার বিপ্লবের মাধ্যমে কায়েম হয়েছে।

বাসস জানায়, যুদ্ধকালীন ৯ মাসের দেশের পরিস্থিতি অবহিত করতে বঙ্গবন্ধুর জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী (তাজউদ্দীন আহমদ) বলেন, যখনই প্রয়োজন হবে মন্ত্রিসভার বৈঠক হবে।

  

সায়েম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত

১১ জানুয়ারি বিচারপতি জনাব এ এম সায়েমকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়। বাসস এই খবর পরিবেশন করে। নিয়োগের পরের দিন ১২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।

কূটনৈতিক পদক্ষেপ শুরু

কূটনীতি সচল হয়ে ওঠে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। ১১ জানুয়ারি সকালে শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে বলেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবেন। এদিকে জার্মান গণসাধারণতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বলে নয়াদিল্লি থেকে এএফপি খবর প্রকাশ করে।

ভারত সরকার বাংলাদেশকে ২৫ কোটি টাকা মূল্যের কাঁচামাল, ইস্পাত, সার, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য দ্রব্য দান হিসেবে সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে বলে বাসস এর খবরে জানানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির শিল্প ও কৃষি খাতগুলোকে আবারও চালু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রায় ৫০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং ঋণ দিতে সম্মত হয় ভারত সরকার।

  

যুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু

যুদ্ধকালীন নির্যাতনের শিকার ও অভিভাবকহীন নারীদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী মহিলা লীগের সম্পাদিকা বদরুন্নেসা আহমদ এক উদ্যোগ নেন। তিনি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার নারীদের নিজ নিজ অবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতি বিবৃত করে নির্ধারিত ঠিকানায় জানানোর আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেন।

একইদিনে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি আবদুল খালেক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই আহ্বান জানান। বিপিআই খবরে প্রকাশ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবদুল খালেক অবিলম্বে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের তদন্ত শুরু, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা তৈরি ও এই নির্যাতনের জন্য দায়ী পাকিস্তানি বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের জন্য ভারত সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানোর জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০২০ 

SUMMARY

2618-১.jpg