এমরান হোসাইন শেখ
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভাটি গতানুগতিক জনসভার মতো ছিল না। এটি কোনও দলের ব্যানারেও আয়োজন করা হয়নি। বর্তমানের সভা-সমাবেশের মতো প্রধান অতিথি, সভাপতি হিসেবে কেউ নির্ধারিত ছিলেন না। জনসভার একমাত্র বক্তা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একাই বক্তব্য রেখেছিলেন। এর বাইরে অন্যরা কেবল বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা বা স্লোগান দেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জনসভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতা ও সেখানে উপস্থিত হওয়া ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের লেখা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সেই দিনটি ছিল রবিবার। ফাল্গুন মাসের সেই সময়টায় শীত বা গরম কোনোটাই ছিল না। আকাশ ছিল পরিষ্কার, তবে কড়া রোদ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা ২টা। তবে বেলা ১১টা বাজতেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় সেদিনের রেসকোর্স আর আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। জাতির জনক বিকাল সোয়া ৩টায় পৌঁছান সেখানে, সাড়ে ৩টায় ভাষণ শুরু করেন।
এদিকে ৭ মার্চের জনসভার আগে বড় ধরনের কোনও প্রস্তুতিও নেওয়া হয়নি। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রসমাবেশে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অবশ্য কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভার পর তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে ৩ মার্চ হরতাল ও ৭ মার্চের জনসভার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ৭ মার্চ জাতির জনক স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এমন ধারণা জনমনে ছিল। শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানিদের কাছেও এমনটি মনে হয়েছিল। এ কারণে সরকার কামান, গোলাবারুদ, বোমারু বিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে প্রস্তুত ছিল। এদিকে বঙ্গবন্ধু কী বলেন তা নিজ কানে শোনার জন্য আগেভাগেই সারাদেশ থেকে জনতা ঢাকায় আসতে শুরু করেন। তারা পায়ে হেঁটে, লঞ্চে বা বাসে-যে যেভাবে পারেন ঢাকায় চলে আসেন। ওই সমাবেশে ১০ লাখের বেশি লোক উপস্থিত হয়েছিলেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ছাত্রনেতা ও বর্তমান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ জানান, ‘আন্দোলন ও মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়েই শেখ মুজিব ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্র সমাবেশে ৭ মার্চ ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন।’ ৭ মার্চের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘ওইদিন সকাল থেকেই আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। জাতির জনকের সঙ্গে দুপুর ১২টায় দেখা করি। আমরা ধানমন্ডি থেকে রওনা করি পৌনে ৩টায়। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই সোয়া ৩টায়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা আরম্ভ করেন সাড়ে ৩টায়। আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্নপথে তাঁকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। মঞ্চে সকাল থেকেই গণসংগীত চলছিল। সেদিন শেখ মুজিব সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। ওই সভায় কোনও সভাপতি, প্রধান অতিথি নির্ধারিত ছিল না। কোনও ব্যানারও ছিল না। এ ধরনের সভা-সমাবেশে এগুলো থাকে না।’ জনসভার মঞ্চ থেকে তিনিসহ অন্য নেতারা কেবল বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা ও স্লোগান দিচ্ছিলেন বলে জানান।
ওইদিন পাকিস্তান সরকারের প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিন সরকারের প্রস্তুতি। যেটা তিনি আমাদের বলেছিলেন। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান এবং হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলে গোলাবর্ষণ শুরু হবে। বঙ্গবন্ধু সবকিছু জেনেই বক্তৃতা করেছেন। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন, স্বাধীনতার ডাক দিলেন, আবার চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না।’
লেখক কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ ৭ মার্চের জনভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, ‘মানুষ উদগ্রীব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু যে ৭ মার্চ ভাষণ দেবেন তার কথা তিনি ১ মার্চ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন ৭ মার্চ তিনি কর্মসূচি ঘোষণা দেবেন। এটা জানার পর ৫/৬ তারিখ থেকেই ঢাকার বাইরের লোকজন পায়ে হেঁটে, বাসে, লঞ্চে যে যেভাবে পারেন ঢাকায় চলে এসেছেন। আজকালের মতো বাসভাড়া করে লোকজন সেখানে আনতে হয়নি। মনের টানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে যোগদান করেন।’
তিনি জানান, ‘৭ মার্চ সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা ২টা। ভোর থেকেই সেখানে লোকজন জড়ো হতে থাকে। বেলা সাড়ে ১১টার সময় গিয়ে দেখি রেসকোর্স এক জনসমুদ্র।’ তিনি জানান, জনতার ভিড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর ঘণ্টাখানেক দেরি হয়।
তিনি বলেন, ‘সেটি কোনও প্রথাগত জনসভা ছিল না। অন্য সভার সঙ্গে এই সভার কোনও মিল নেই। এটা স্বাভাবিক সভার মতো হয়নি। ওই সভায় তিনি একাই বক্তা। শুধু ঘোষণা মঞ্চ থেকে বারবার বঙ্গবন্ধুর কথা বলা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু আসবেন, কিছুক্ষণ পর আসবেন.. ইত্যাদি।’
তিনি জানান, ‘লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত স্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নীরবতা। লাখ লাখ লোকের সমাবেশ, কোনও বিশৃঙ্খলা বা উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। সবাই একেবারে নীরব। ভাষণের আগে-পরে স্লোগান ছাড়া সমাবেশস্থল ছিল নীরব নিঃশব্দ।’
জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, ‘হরতাল-কারফিউর মধ্যে ১০ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিত হওয়া ছিল অভূতপূর্ব বিষয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবই লাঠিসোঁটা, বৈঠা, যার কাছে যা আছে তা নিয়ে সমাবেশে হাজির হয়। খালি হাতে কেউ আসেনি। পাকিস্তানিরা গোলাবারুদ, ট্যাংক, কামানসহ অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রস্তুত হয়েছিল। হেলিকপ্টারে এলএমজি ফিট করা ছিল। বাজারে গুজব ছিল, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে ওই মাঠে জালিয়ানাবাগের মতো গুলি চালানো হবে। বঙ্গবন্ধুর যাতে কিছু না হয় তার জন্য আমি, সিরাজুল আলম খান, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ, মহিউদ্দিন আমরা সবাই তাঁকে কর্ডন করে ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আমরা রাজনৈতিকভাবে আলাদা হলেও এটা বলতেই হবে, বঙ্গবন্ধু সেদিন আপসহীন অবস্থান যদি না নিতেন তাহলে স্বাধীনতা যুদ্ধ হতো না। আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না। আমাদের একজন নেতার প্রয়োজন ছিল। আমরা কাউকেই পাইনি, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০২০