উদিসা ইসলাম
১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের স্মৃতিতে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত। তার স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায়, কীভাবে সেই রাতে বঙ্গবন্ধু ছটফট করছিলেন, কীভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী হামলা করেছিল, কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেদিন শেখ রেহানাকে বলেছিলেন, ‘বিপদে কাঁদতে নেই, মা।’
বেগম মুজিব বলেন, গত বছর ২৫ মার্চের সকাল থেকে বাড়ির অবস্থা ভার লাগছিল। তখন প্রায় সাড়ে ১২টা। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সৈন্য-বোঝাই দুটো ট্রাক চলে গেলো। দোতলা থেকে ট্রাকগুলো দেখে আমি নিচে নেমে এলাম। তখনও আগত লোকদের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। তাকে ভেতরে ডেকে মিলিটারি সম্বন্ধে বলতে দেখলাম তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো।
পরক্ষণেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। সমস্ত দিনটা কেটে গেল থমথমে ভাবে। রাত সাড়ে ৮টায় তিনি সাংবাদিকদের বিদায় দিলেন। আওয়ামী লীগ সহকর্মীদের কিছু কিছু নির্দেশ দিয়ে দ্রুত বিদায় দিলেন। রাত প্রায় ১০টার কাছাকাছি কলাবাগান থেকে এক ভদ্রলোক এসে শেখ সাহেবের সামনে একেবারে আছড়ে পড়লেন। তার মুখে শুধু এক কথা, ‘আপনি পালান, বঙ্গবন্ধু পালান।’ ভেতর থেকে তার কথা শুনে শঙ্কিত হয়ে উঠল আমারও মন। বড় মেয়েকে তার ছোট বোনটাসহ তার স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। যাওয়ার মুহূর্তে কী ভেবে যেন ছোট মেয়েটা আমাকে আর তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। শেখ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললেন, ‘বিপদে কাঁদতে নেই, মা।’
তখন চারদিকে সৈন্যরা নেমে পড়েছে। ট্যাংক নেমে পড়েছে পথে। তখন অনেকেই ছুটে এসেছিল ৩২ নাম্বারের এই বাড়িতে। বলেছিল, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি সরে যান।’ উত্তর দিয়েছিলেন তিনি, ‘না, কোথাও আমি যাবো না।’
এরপর আক্রমণের বিবরণে শেখ মুজিব বলেন, রাত ১০টা থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো। দূর থেকে তখন গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। দেখলাম প্রতিটা শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে শেখ সাহেব সমস্ত ঘরটার মাঝে পায়চারী করছিলেন। অস্ফুটভাবে তিনি বলছিলেন, ‘এভাবে বাঙালিকে মারা যাবে না। বাংলা মরবে না।’ রাত ১২টার পর থেকে গুলির শব্দ এগিয়ে এলো। ছেলেমেয়েদের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম, পাশের বাড়িতে সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে। স্পষ্ট মনে আছে, এ সময় আমি বাজের মতোই ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম, ‘গো অন, চার্জ।’ সেই সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো অঝোরে গোলাবর্ষণ।
এই তীব্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যে অনুভব করলাম, সৈন্যরা এবার আমার বাড়িতে ঢুকেছে। নিরুপায় হয়ে বসে ছিলাম আমার শোবার ঘরটাতে।বাইরে থেকে মুষলধারে গোলাবর্ষণ হতে থাকলো এই বাড়িটা লক্ষ করে। ওরা হয়তো এই ঘরটার মাঝেই এমনিভাবে গোলাবর্ষণ করে হত্যা করতে চেয়েছিল আমাদের। এমনভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, সমস্ত বাড়িটা বোধহয় ধসে পড়বে। বারুদের গন্ধে মুখ-চোখ জ্বলছিল। আর ঠিক সেই দুরন্ত মুহূর্তটাতে দেখছিলাম, ক্রুদ্ধ সিংহের মতো সমস্ত ঘরটার মাঝে অবিশ্রান্তভাবে পায়চারী করছেন শেখ সাহেব। তাকে এভাবে রেগে যেতে কখনও আর দেখিনি। রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে ওরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপরে উঠে এলো। ততক্ষণ শেখ সাহেব কিছু বলেননি। কিন্তু এবার অস্থিরভাবে বেরিয়ে গেলেন ওদের সামনে। পরে শুনেছি সেই সময় তাকে হত্যা করে ফেলতো যদি না কর্নেল দুই হাত দিয়ে তাকে আড়াল করতো। ধীর স্বরে শেখ সাহেব হুকুম দিলেন, গুলি থামানোর জন্য। তারপর মাথাটা উঁচু রেখেই নেমে গেলেন। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আবার উঠে এলেন উপরে।
জামাল এগিয়ে দিলো তার হাতঘড়ি, মানিব্যাগ। স্বল্প কাপড় গোছানো সুটকেস আর বেডিংটা তুলে নিলো সৈন্যরা। যাওয়ার মুহূর্তে একবার শুধু ফিরে তাকালেন আমাদের দিকে। পাইপ ও তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সঙ্গে। সোফার নিচ থেকে, খাটের নিচ থেকে, আলমারির পাশ থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন দলীয় কর্মী। আস্তে আস্তে বললো, ‘মাগো আমরা আছি। আমরা আছি।’
সবার মাঝে দাঁড়িয়ে সে রাতে কেঁদে ফেলেছিলেন জানিয়ে বেগম মুজিব তার স্মতিচারণায় বলেন, তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘খোদার কাছে হাজার শুকুর। তোদের অন্তত ফেরত পেয়েছি। তোরা অন্তত ধরা পড়িসনি।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ২৫, ২০২০