উদিসা ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১ মে জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে নিম্ন আয়ের মানুষদের বাড়তি আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গঠনে আত্মনিয়োগেরও আহ্বান জানান তিনি। নবগঠিত একটি রাষ্ট্রে নিম্নবিত্তকে সঙ্গে নিয়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি বেশ অভিনন্দিত হয় সেসময়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গৃহীত সরকারি পদক্ষেপগুলো উল্লেখ করেন।
মে দিবসের প্রাক্কালে শ্রমিকদের দাবি বা আন্দোলন কিছু না থাকলেও এধরনের ঘোষণা সবাইকে কাজে উদ্বুদ্ধ করবে বলে বৃদ্ধিজীবীরা মত প্রকাশ করেন। ১৯৭২ সালের ২ মে পত্রিকা প্রকাশ না হওয়ার কারণে ৩ মে’র সংবাদপত্রে মে দিবসের সংবাদ প্রকাশিত হয়।
বাসসের বরাত দিয়ে পত্রিকার খবরে প্রকাশ বঙ্গবন্ধু সেদিনের ভাষণে বলেন, ‘জনসাধারণের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করবো।’ জনসাধারণের দুঃখ ও কষ্ট লাঘবের জন্য গৃহীত সরকারি ব্যবস্থাগুলোর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষকদের সব বকেয়া খাজনা মাফ করে দেওয়া হয়েছে। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা আদায় রহিত করা হয়েছে। লবণের আবগারি শুল্ক আদায় বন্ধ, নিপীড়নমূলক ইজাদারি প্রথা বাতিল এবং ১৬ কোটি টাকা ঋণ আকারে বণ্টন হয়েছে। আরও ১০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হবে। ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শিক্ষায়তনগুলো পুনর্নির্মাণ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৮৭টি রেলসেতুর মধ্যে ২৬২টি এবং ২৭৪টি সড়কসেতুর মধ্যে ১৭৭টি মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে।’
বেতন বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতে সরকারের বাড়তি ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।’ ৭০ কোটি টাকা বকেয়া খাজনা মাফ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণ করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারের জাতীয়করণ কর্মসূচি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে একটি বলিষ্ঠ ও সাহসী পদক্ষেপ। পুরনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বাদ দিয়ে আমরা সমাজতন্ত্রের পথ নিয়েছি আজ। আমাদের ওপর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গঠনের দায়িত্ব বর্তেছে। এই নয়া ব্যবস্থা কায়েমে শ্রমিক শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।’
৩ মে’র দৈনিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় সেদিনের প্রথম পাতায় ছাপা হয়। মহান মে দিবসে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া ব্যবস্থাকে অভিনন্দিত করে তারা। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়— এধরনের ব্যবস্থাগুলো আমাদের অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ নতুন, তুলনা বিহীন ও অপ্রত্যাশিত। দেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ও কর্মচারীর জন্য কল্যাণমূলক একটি ব্যবস্থা গৃহীত হলো। আন্দোলনের বা দাবি উত্থাপনের অবকাশ হলো না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার নিম্নবিত্ত মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধা বিবেচনা করে নিয়ে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করলো।
একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান মে দিবসের ঘোষণাটিকে বিভিন্ন মহল অভিনন্দিত করে। বঙ্গবন্ধু যে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা করেছেন, সেটির সাফল্য ঘরে তোলার জন্য এটি একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, বাংলাদেশ এবারের মে দিবস ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। আগে দিবসটি পালিত হতো ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে শোষণ ও পুঁজিবাদের অবসান চায় বলে, এবার মে দিবস পালিত হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে।
তারা বলছেন, মেহনতি শ্রমিকদের জন্য কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধার কথা ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু। এই দিনে দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন বুকের রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য। দেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়েছে কল্যাণ ব্রত রাষ্ট্রের। তাই এবারের মে দিবসে বাংলাদেশে সূচিত হয়েছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষের সোচ্চার হওয়া থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের এক সাফল্যজনক অগ্রগতি সামনে রেখে।
কারা কয় টাকা পাবেন
স্বায়ত্তশসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, জাতীয় রক্ষী বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস পরিচালিত শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সদস্য সংখ্যা বাড়াতে আর্থিক সাহায্য পাবে। যেসব সরকারি কর্মচারী ৩৩৫ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পান, তারা স্বাভাবিকভাবেই সাহায্য পাবেন। যাদের মাসিক বেতন ১২৫ টাকা পর্যন্ত তারা পাবেন বাড়তি ২৫ টাকা। যাদের মাসিক বেতন ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত তারা পাবেন ২০ টাকা। পহেলা মে থেকে ঘোষণা কার্যকরী হয়েছে এবং পহেলা জুনের বেতনের সঙ্গে ওপরে বর্ণিত কর্মচারীরা বাড়তি টাকা পাবেন।
সুত্র: বাঙলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মে ০১, ২০২০