বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের পিতা শেখ মুজিব

মোস্তাফা জব্বার 

আমরা বাঙালি হিসেবে একদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ঋণী যে তারা কেবল যে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু হিসেবে সম্মানিত করেছেন। জাতিসংঘের একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এটি না হলেও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আমাদের মহান নেতাকে যতটা সম্মান দিলেন তা আমার জন্য এক গৌরব তিলক। অন্যদিকে বিশ্বসংস্থার পক্ষ থেকে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার স্মৃতিকে বিশ্বজুড়ে সম্মান নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে তার জন্যও আমরা বিশ্ব সংস্থার কাছে কৃতজ্ঞ।

২০২০ সালের ১৭ মার্চ আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করব। বিশ্বের একমাত্র বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকী পালন যে কত গৌরবের সেটি কেবল আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকরা পরিপূর্ণভাবে অনুভব করব। তবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষীও অন্তত বিশ্বের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্র তার জনককে নিয়ে গর্ববোধ করবে। বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য আরো গৌরবের বিষয় যে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী পালনের পরের বছরই আমরা আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। বস্তুত ২০২১ সালের এই জোড়াবর্ষে সারা বিশ্বে বাঙালি তার জাতিরাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মূল নীতিমালা, রাষ্ট্রের পিতা, ৫০ বছরের অর্জন যেমন করে তুলে ধরবে তেমনি করে একটি লাঙল-জোয়ালের দেশকে কেমন করে ডিজিটাল বিপ্লবের দেশে পরিণত করছে সেটাও দেখাবে। এবার ২০১৯ সালে সারাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে বাঙালি জাতির পিতা যেমনি শেখ মুজিব তেমনি বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে তোলার প্রাণপুরুষ একজনই- শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলাম, এবার জাতিসংঘের আলোচনায় তিনি বিশ্ববন্ধুর অভিধা পেলেন।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বক্তারা। ১৫ আগস্ট সংস্থাটির সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো জাতীয় শোক দিবসের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় জাতিসংঘের কনফারেন্স রুম ৪-এ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন জাতিসংঘের সদস্য দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা, নিউইয়র্কের যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার মানবাধিকার কর্মী, লেখক, চলচ্চিত্র শিল্পী, টিভি উপস্থাপক, ফটোগ্রাফার এবং প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনরা।
এর আগে সকাল ৯টায় স্থায়ী মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে জাতির পিতার ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি শুরু করা হয়। এ সময় ১৫ আগস্টের শহীদদের উদ্দেশে মিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ এবং ১৫ আগস্টের শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়ার মাধ্যমে সকালের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি শেষ হয়। বিকেলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত শোক দিবসের মূল অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। এ সময় দেশি-বিদেশি অতিথিরা জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর জাতির পিতার জীবন ও কর্ম এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও বহুপাক্ষিকতাবাদ’ বিষয়ে কি-নোট স্পিচ প্রদান করেন জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। বক্তব্য দেন ভারত, সার্বিয়া ও কিউবার স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক। প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের পক্ষে বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। সাংস্কৃতিক পর্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা ও গান পরিবেশন করা হয়। সবশেষে জাতির পিতা, বঙ্গমাতা এবং ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রিতে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হাতে নৃশংসভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। রাষ্ট্রদূত মাসুদ তার স্বাগত ভাষণে জাতির পিতা জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকারের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি, গণতন্ত্র, শান্তি ও সহাবস্থানের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা তুলে ধরেন।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো জাতির পিতার শাহাদতবার্ষিকীর এ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা আগামী বছর বিশ্বব্যাপী জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। সে উপলক্ষে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি ২০২১ সালে উদযাপন করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।’ এসব অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান স্থায়ী প্রতিনিধি। জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি জাতির পিতার সঙ্গে তার কর্মজীবনের নানা ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তুলে ধরা, বহুপাক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নেয়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যেসব অবদান রাখেন তা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ ধারণ করেই বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতাবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বসভায় ভূমিকা রেখে চলেছে।
ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেন, ‘১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারতবাসী তাদের অকৃত্রিম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা জানতে পারে তখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়।’ বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শই আজ জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
সার্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিলান মিলানোভিচ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিকা দাচ্চির বাণী পড়ে শোনান। এ বাণীতে সার্বিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাবেক যুগোস্লাভিযার রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ ব্রোজো টিটোর যে বন্ধুত্ব ও গভীর সম্পর্ক তা তুলে ধরেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি ‘বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, আর আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও এটা যে আমি তাদের অনেক বেশি ভালোবাসি’ উল্লেখ করেন।
কিউবার রাষ্ট্রদূত আনা সিলভিয়া রদ্রিগেজ আবাসকাল তার বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার দেয়া অকুণ্ঠ কূটনৈতিক সমর্থনের কথা তুলে ধরেন। নির্যাতিতের পক্ষে ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব, প্রচেষ্টা ও সাহসের কথা বলতে গিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালে কিউবার মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতি ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাই হিমালয় দেখার সাধ আর আমার নেই’ উল্লেখ করেন।
ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ এইচ মনসুর ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আজ ৪৪ বছর পর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে, যা এ বিশ্বনেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অনন্য উদ্যোগ।’
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান মুজিব শতবর্ষ উদযাপনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বক্তারা বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির প্রতিভূ ও বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তারা বলেন, বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার সংগ্রাম ও ত্যাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।
জাতিসংঘে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল মিজ সাদিয়া ফয়জুনেচ্ছা এবং স্থায়ী মিশন, কনস্যুলেট ও জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মুকিত চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রবাসী বাংলাদেশিরা। (১৫ আগস্ট ২০১৯-জাগো নিউজ-এর খবর)
আমি কৃতজ্ঞচিত্তে জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী মিশনকে ধন্যবাদ দিই। জাতির পিতার মহাপ্রয়াণের ৪৪ বছর পরে হলেও তারা যে উদ্যোগটি নিয়েছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে জাতির পিতাকে তুলে ধরেছে সেটি একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা। আমি প্রত্যাশা করব আমাদের এই প্রচেষ্টা বিশ্বজুড়ে ব্যাপৃত হবে এবং বিশ্বের সব দেশ জানবে বাংলা নামে ভাষা আছে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র আছে এবং সেই জাতিসত্তা গড়ে তোলার নায়ক একজন আছেন যিনি বাঙালি জাতির পিতা।
আমরা বাঙালি হিসেবে একদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ঋণী যে তারা কেবল যে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু হিসেবে সম্মানিত করেছেন। জাতিসংঘের একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এটি না হলেও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আমাদের মহান নেতাকে যতটা সম্মান দিলেন তা আমার জন্য এক গৌরব তিলক। অন্যদিকে বিশ্বসংস্থার পক্ষ থেকে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার স্মৃতিকে বিশ্বজুড়ে সম্মান নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে তার জন্যও আমরা বিশ্ব সংস্থার কাছে কৃতজ্ঞ। বিশ্বের চতুর্থ মাতৃভাষা বাংলার এই অসাধারণ সম্মান দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রথমত বাংলা যে একটি বিশ্বভাষা সেটি প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত আজ যারা বাংলাদেশের নাগরিক তারাই যে বাংলা ভাষার মূল স্রোত সেটিও প্রমাণিত হয়েছে। এই কারণগুলোতে মনোযোগ দিয়েই আমাদের সম্ভবত প্রমাণ করার সময় হয়েছে যে বিশ্বের একমাত্র বাংলা ভাষার রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অতি আবশ্যকীয়ভাবেই জাতির পিতা। জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকীকে সামনে রেখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমি একটু গভীরে অনুসন্ধান করতে চাই বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের এই অসাধারণ বিজয়কে এবং তার পাশাপাশি শ্রদ্ধা জানাতে চাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ একজনই বাঙালিকে।

(২য় কিস্তি)

চার দশকেরও বেশি সময় আগে বাংলার মাটিকে রক্ত দিয়ে পবিত্র করে যাকে সপরিবারে শহীদ হতে হয়েছিল তার সম্পর্কে দুটি বাক্য লিখতে আর কার কী হয় জানি না, আমার তো হাত কাঁপে। কোনোভাবেই আমি তাকে নিয়ে লেখার সাহস পাই না। এত বড় মাপের মানুষ তাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার মতো নগণ্য একজনের থাকতেই পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম সশরীরে দেখি ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। সেই থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত তাকে কাছে এবং দূরে থেকে দেখেছি। দেশের আরো রাজনৈতিক নেতাকেও দেখেছি। মাওলানা ভাসানী, কমরেড মনি সিংহ বা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদদের রাজনীতি পর্যবেক্ষণও করেছি। আজ এত বছর পরেও যদি সব রাজনৈতিক নেতাকে মূল্যায়ন করি তবে শ্রদ্ধায় অবনত হওয়ার মতো মানুষ একজনকেই পাই। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তার নাম শুনেছি ১৯৬৬ সালে, যখন ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্রলীগ করা শুরু করি। সেখানেই ছয় দফা নামক একটি লিফলেট বিলাতে গিয়ে প্রথম জেনেছি যে বাঙালিরা তাদের প্রাপ্য পায় না। তার আগে সারাটা স্কুল জীবনে পাক সার জমিন সাদ বাদ গেয়ে পাকিস্তানি হওয়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৬৫ সাল ছিল প্রথম যখন ঢাকা শহরে এসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কুশপুত্তলিকা জ্বালাতে দেখেছি। ছয় দফা পাঠ করে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, আমি বাঙালি এবং আমার একটি আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা ভূখণ্ড রয়েছে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শুনলাম, বাঙালিদের একজনই নেতা, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর ১১ দফায় সেই ছয় দফা যুক্ত হয় আর রাজপথে তার মুক্তির দাবিতে মিছিল করা দিয়ে নিজের স্লোগান দেয়ার ক্ষমতাকে শানিত করি। তাকে দেখি যে দিন তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয় সে দিন। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগণ্য একজন কর্মী হিসেবে তার সামনে যাওয়ার কোনো কারণই ছিল না। তবে যারা তার কাছে থাকতেন তাদের সঙ্গে আমরা দিন-রাত কাটাতাম বলে তার ব্যক্তিগত ভাবনা-জীবনাচার বা রাজনৈতিক দর্শন জানতে পারতাম। সেই মানুষটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যে সময়ে ব্রিটিশরা পুরা উপমহাদেশটিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলঙ্কিত করে দুটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল এবং পুরো উপমহাদেশের তাবৎ বড় বড় রাজনীতিবিদরা সেই সাম্প্রদায়িকতাকেই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তখন তিনি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের দূরদর্শী স্বপ্ন দেখেন। ভাবা যায় যে পাকিস্তান তৈরির ৫ মাসের মাঝে জিন্নাহর মুখের ওপর কেউ না না চিৎকার করে নিজের মাতৃভাষার দাবিকে উত্থাপন করতে পারেন। এই অঞ্চলে ভাষারাষ্ট্র ধারণা তখন মোটেই গুরুত্ব পায়নি। বঙ্গবন্ধু সেই মানুষটি যিনি বাংলাদেশের অন্তরকে অনুভব করেন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বাঙালি যে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সবার ওপরে ঠাঁই দেয় এবং তার এই জীবনধারায় ধর্ম যে প্রধান শক্তি নয় সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আমি নিজে অভিভূত হই যখন দেখি যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে থেকে তার রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি উপড়ে ফেলে দিতে পারেন। যে মানুষটি নিজেকে স্পষ্ট করে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারেন যে, তিনি বাঙালি, মানুষ এবং তারপরে মুসলমান, কেবল সেই মানুষটিই পাকিস্তানের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের চোখের সামনে পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারেন! আজ তার মৃত্যুর চার দশকেরও বেশি সময় পর আমাদের আইনমন্ত্রীকে বলতে হয় যে, আমরা অবশ্যই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাব। তিনি নিজেই অনুভব করেন যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আমরা ফেরত যেতে পারিনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা দেশটিকে যেভাবে পাকিস্তানের দূরবর্তী অঙ্গরাজ্য বানিয়েছিল, সেটির জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রণীত সংবিধানে আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে ফিরে যেতে পারিনি। আমরা সংবিধানে কেবল বিসমিল্লাহ রাখিনি তাতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও রেখেছি। আমার জানা মতে তার হাতে তৈরি ১৯৭২ সালের সংবিধানটি হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম সেরা সংবিধান, যার সঙ্গে তুলনা করার মতো কোনো সংবিধান অন্তত এই অঞ্চলে পাওয়া যায় না।
আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে বুঝবেন না যেভাবে আমরা তাকে চিনি। তাকে বুঝতে হলে পড়তে হবে, জানতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব, তার প্রতি একনিষ্ঠতা এবং জাতিসত্তা বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট নীতিমালা আমার মতো লাখো লাখো তরুণকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনে জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যারা এখন মনে করেন যে, পাকিস্তান আমাদের ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি এবং বনিবনা হয়নি বলে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে বুঝতেই পারেন না। কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমনভাবে গড়ে তোলেন যে সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এটি প্রমাণ করেছি যে আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই তিনি বুঝেছিলেন যে, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন বাঙালিরা দেখেছিল সেই পাকিস্তান জন্মই নেয়নি। কেবল তাই নয় হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান বিভাজনের সময় বাংলার বিভাজন ও বাংলার ন্যায্য পাওনা অঞ্চলগুলোকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানে বাঙালিদের সংখ্যা কমানোর প্রচেষ্টাতেই তিনি অনুভব করেছিলেন- পাকিস্তানের তথাকথিত স্বাধীনতা বাঙালির স্বাধীনতা নয়। এরপর ১৯৪৮ সালেই তিনি এটি বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য নয়। সে জন্যই তিনি ভাবেন যে বাঙালিদের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে জন্য তিনি একদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতিও গড়ে তুলেছেন।
বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বুঝতে হলে তার তৈরি করা ১৯৭২-এর সংবিধান বুঝতে হবে। তার ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিল চারটি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ধীরে ধীরে আমরা সেই চার নীতির গণতন্ত্র ছাড়া বাকি সবগুলোকেই এড়িয়ে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করে না। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ধারণার পথ ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। হয়তো কার্ল মার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র ও তার ধারণা কাজে লাগানো ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। এক সময়ের কায়িকশ্রমনির্ভর মালিক-শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধাশ্রমভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শ্রেণিচরিত্র বা শ্রেণিসংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাবে। কোনো এক মার্ক্সকে নতুন করে সমাজতন্ত্রের মূলকথা বর্ণনা করতে হবে- ব্যাখ্যা করতে হবে। তবে সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যহীনতার ধারণাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে না। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বাংলাদেশকে আবার লড়াই করতে হচ্ছে। জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধর্ম পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর যে অসাধারণ দৃঢ়তা ছিল মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতি, তার প্রথম স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই। তিনি কৃষিপ্রধান রাষ্ট্রের গরিব মানুষদের জন্য ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ করে দেন এবং জমির সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দেন। তিনি এটি স্পষ্টতই অনুভব করেছিলেন যে বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিভিত্তিক দেশের প্রধান সম্পদের নাম জমি। সেই কারণে ভূস্বামীদের হাতে জমি রাখা যাবে না। স্পষ্টতই তিনি শ্রেণিবৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর বাঙালির ভাষা আন্দোলনের বিষয়টির বাইরেও বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সেই ভাষণের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি, যেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে সরকারি অফিসের সব কাজ বাংলাতেই হবে। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি যে, মুজিব অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার বানিয়েছিলেন। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ডিজাইন করা মুনীর কিবোর্ডকে ভিত্তি করে পূর্ব জার্মানির অপটিমা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে তিনি অপটিমা মুনীর তৈরি করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করেন।
যে ভাষা রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখানে থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি, সেটি আমি মোটেই বুঝি না। আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সব ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালিকেই অনুসরণ করি যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিন
আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে অনুভব করবেন না, যেভাবে আমরা যারা সরাসরি তার সৈনিক হিসেবে জীবন শুরু করেছি তারা তাকে চিনি। তাকে দেখার, তার সঙ্গে সৈনিক হিসেবে কাজ করার বাড়তি সুবিধাটি আমাদের আছে। তবে নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকে অনুধাবন করতে হবে। তাকে উপলব্ধি করতে হলে পড়তে হবে, শুনতে ও দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি তার একনিষ্ঠতা এবং জাতিসত্তা বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট নীতিমালা আমার মতো লাখো লাখো তরুণকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনে জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মাঝে নিজস্ব সত্তা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঠিক সেই সময়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রকাশ্য ঘোষণা প্রদান করেন যখন তার প্রয়োজন দেখা দেয়।
আলোচনা হতেই পারে যে, বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও করেছিলেন। জানা দরকার সেই পাকিস্তান তৈরির আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি জাতির পিতার সম্পৃক্ততার প্রেক্ষিতটা কী ছিল। প্রথম যে বিষয়টি বোঝা দরকার, সেটি হচ্ছে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় লেখাপড়া করার সময় সর্বভারতীয় রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। পুরো ভারতবর্ষের রাজনীতি তখন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগে বিভক্ত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মুসলিম লীগের মাধ্যমেই সর্বভারতীয় রাজনীতির স্রোতধারাতেও মিশে যান। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। সেই মুসলিম লীগের রাষ্ট্রচিন্তাই বস্তুত বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার নিয়ামক হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়াতে এবং ভারতীয় নেতাদের মতামত না নিয়ে ভারত সরকারের যুদ্ধে যোগদানের কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা আলোচনা করতে এবং ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণের জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশন আহ্বান করেন।
মুসলিম লীগের কর্মীদের একটি ক্ষুদ্র দল নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ লাহোরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলার মুসলিম লীগ দলের নেতৃত্ব দেন এ কে ফজলুল হক এবং তারা ২২ মার্চ লাহোরে পৌঁছেন। বাংলার প্রতিনিধি দলকে বিপুল জয়ধ্বনি দিয়ে বরণ করা হয়।
জিন্নাহ তার দুই ঘণ্টারও অধিক সময়ব্যাপী বক্তৃতায় কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সমালোচনা করেন এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি দাবি করার পেছনের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন। তার যুক্তিগুলো সাধারণ মুসলিম জনতার মন জয় করে।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন, যা আলোচনা ও সংশোধনের জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাবজেক্ট কমিটি সমীপে পেশ করা হয়। সাবজেক্ট কমিটি এ প্রস্তাবটিতে আমূল সংশোধন আনয়নের পর ২৩ মার্চ সাধারণ অধিবেশনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সেটি উত্থাপন করেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও অন্যান্য মুসলিম নেতা তা সমর্থন করেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ৩৮ পৃষ্ঠায় লাহোর প্রস্তাব উল্লেখিত রয়েছে। লাহোর প্রস্তাব : ২৩ মার্চ ১৯৪০। লাহোর প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ- প্রস্তাবের প্রথম দুটি অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, মুসলিম লীগ ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ অনুসারে প্রস্তাবিত ফেডারেশন ধারণাকে সমর্থন করে না।

3. Resolved that it is the considered view of the session of the All-India Muslim League that on constitutional plan would be workable in the country or acceptable to the Muslims unless it is designed on the following basic principles, viz, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India should be grouped to constitute ‘independent states’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.

4. That adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for the minorities in the units and in the regions for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.

5. This session further authorizes the Working Committee to frame as scheme of constitution in accordance with these basic principles, providing for the assumption finally by the respective region of all power such as defense, external affairs, communications, customs and such others matters as may be necessary.

লাহোর প্রস্তাবের অনুচ্ছেদ ৩-এ বলা হয় যে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেটস্) গঠন করতে হবে যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। রাষ্ট্রসমূহে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার রক্ষার কথাও বলা হয়। কেবল তাই নয়, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, যোগাযোগ, কাস্টমস ও অন্যান্য বিষয়ও বিভিন্ন অঞ্চলসমূহকে কতটা কীভাবে প্রদান করা যায় তারও প্রস্তাব ছিল লাহোর প্রস্তাবে। ১৯৪০ সালের প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তানের উল্লেখ নেই এবং ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের’ দাবি জানাতে গিয়ে লীগের মুখপাত্ররা কী চাচ্ছেন সে সম্পর্কে মোটেও দ্ব্যর্থহীন ছিলেন না।
১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌল বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত এটি দলটির প্রধান বিষয় ছিল।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৪০ সালের পরবর্তী সময় থেকে ভারতীয় স্বাধীনতার বিতর্কের প্রধান প্রসঙ্গ ছিল পাকিস্তান। ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং স্বশাসনকে সহজতর করার সাহায্যকল্পে ১৯৪৬ সালের মার্চে যখন একটি ব্রিটিশ মিশন ভারতে পৌঁছে, তখন ৭ এপ্রিল দিল্লিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তাদের ‘পাকিস্তান দাবি’র পুনরাবৃত্তি করতে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের তিন দিনব্যাপী এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি চৌধুরী খালিকুজ্জামান, হাসান ইস্পাহানি ও অন্যদের সমবায়ে একটি উপকমিটি নিয়োগ করে। চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রস্তাবের একটি খসড়া তৈরি করেন। অন্য সদস্যদের সঙ্গে খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সামান্য পরিবর্তনের পর উপকমিটি এবং অতঃপর সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ‘স্টেটস’ শব্দটিকে একবচন শব্দ ‘স্টেট’-এ পরিবর্তন করা হয়। এ পরিবর্তন মূল লাহোর প্রস্তাবের মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে।
১৯৪৬ সালে মুসলমান আইন প্রণয়নকারীদের দিল্লি সম্মেলনে যে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয় তাতে নিম্নোক্ত মূলনীতিটি অন্তর্ভুক্ত ছিল- ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলা ও আসাম সমবায়ে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সমবায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিয়ে যে অঞ্চলসমূহ গঠিত, সে অঞ্চলসমূহকে নিয়ে একটি সার্বভৌম স্বাধীন ‘রাষ্ট্র’ গঠন করা হোক এবং কোনো রকম বিলম্ব ছাড়াই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার প্রদান করা হোক। কমিটি এ পরিবর্তনের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।
বস্তুত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ১৯৪৬ সালে বদলে ফেলা হয়। যদিও প্রস্তাবে কেবল একটি ইংরেজি অক্ষর এস কমানো হয় তথাপি ভারতবর্ষে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পুরো ধারণাটিই বদলে ফেলা হয়। উন্মুক্ত অধিবেশনে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন সোহরাওয়ার্দী এবং সমর্থন করেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান। আবুল হাশিম দাবি করেন যে, আগের দিন জিন্নাহ যখন সাবজেক্ট কমিটি সমীপে এটি তোলেন তখন তিনি বৈধতার প্রশ্নে সেখানে প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি অভিমত পোষণ করেন যে, খসড়া প্রস্তাবটিকে লাহোর প্রস্তাবের সংশোধনের মতো মনে হচ্ছিল, যদিও এটা বলা হয়নি অথবা এটাকে লাহোর প্রস্তাবের সংশোধনের আকারে উপস্থাপন করা হয়নি। তিনি এ ধরনের যুক্তি দেখিয়েছেন বলে দাবি করেন যে, লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলগুলোতে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে মনশ্চক্ষে দেখা হয়েছে এবং ১৯৪১ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রস্তাবটিকে ওই রাজনৈতিক দলটির মৌল বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন যে, মুসলিম লীগের আইন প্রণয়নকারীদের দিল্লি সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাবের সারমর্ম পরিবর্তন করা অথবা এর আকারে রূপান্তর আনয়ন করার ব্যাপারে আইনগত বৈধতা ছিল না। জিন্নাহ প্রথমে লাহোর প্রস্তাবের বহুবচনবাচক ‘এস’কে ‘সুস্পষ্ট মুদ্রণ ভ্রম’ হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু যখন আবুল হাশিমের অনুরোধে সভার মূল কার্যবিবরণীর রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখা হয় তখন জিন্নাহ তার নিজের দস্তখতের নিচে বহুবচনবাচক ‘এস’ দেখতে পান। জিন্নাহকে তার প্রতারণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে আবুল হাশিম নিশ্চিতভাবে বলেন যে, তিনি ‘ওয়ান’ শব্দটি ঘষে তুলে ফেলে তদস্থলে অনির্দিষ্টবাচক আর্টিকেল ‘এ’ বসানোর ইঙ্গিত দেন, যাতে জিন্নাহর প্রস্তাব নিম্নোক্ত রূপ ধারণ করে-
আমাদের লক্ষ্য হলো ভারতের উত্তর-পশ্চিমে এবং বাংলা ও আসামকে অন্তর্ভুক্ত করে ভারতের উত্তর-পূর্বে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করা। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব এবং তার বিকৃতি থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম অবধি পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলেই অনুভব করা যাবে যে সাম্প্রদায়িক এই রাষ্ট্রটি কেবল তার মূল ধারণা থেকে বিচ্যুত হয়নি বরং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতারণায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়। মুসলিম লীগের তরুণ কর্মী শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিন্নাহ ও তার সাগরেদদের এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না। তবে লাহোর প্রস্তাব যে তার ওপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল সেটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা দেখলে বোঝা যায়। ছয় দফায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে বাংলাদেশ কী হতে পারত তার ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এতে উপলব্ধি করা যাবে যে, তরুণ শেখ মুজিব কেন পাকিস্তানের পক্ষে মরণপণ লড়াই করেছেন। আরো একটু সামনে পা দিলেই জানা যাবে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালেই জাতির পিতা অনুভব করেন ‘পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য নয়’। আমি ঠিক জানি না লাহোর প্রস্তাব অনুসারে পাকিস্তানের জন্ম হলে বা পাকিস্তান রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মেনে নিলে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা কী হতো। তবে এটি বুঝি যে, বাংলাদেশ নামক একটি ভিন্ন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য যে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ দরকার ছিল সেটি অনেক আগেই শুরু হয়েছিল।
চার

বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই তিনি বুঝেছিলেন, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন বাঙালিরা দেখেছিল সেই পাকিস্তান জন্মই নেয়নি। কেবল তাই নয়, হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান বিভাজনের সময় বাংলার বিভাজন ও বাংলার ন্যায্য পাওনা অঞ্চলগুলোকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানে বাঙালিদের সংখ্যা কমানোর প্রচেষ্টাতেই তিনি অনুভব করেছিলেন- পাকিস্তানের তথাকথিত স্বাধীনতা বাঙালির স্বাধীনতা নয়। তবুও ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। লাহোর প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান তৈরি করা হয়। এর ফলে বাংলা বিভক্ত হয়। আসাম বাংলা থেকে পৃথক হয় এবং পাঞ্জাবও বিভক্ত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের ক্ষুদ্র জাতিগুলো পাকিস্তান নামের কারাগারে বন্দি হয়। সেই পাকিস্তান গড়ে তোলার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে সিলেটের গণভোটে জাতির পিতা সর্বশক্তি দিয়ে অংশগ্রহণ করেন। যদিও পাকিস্তানের গঠনটি মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুসারে হয়নি তবুও পূর্ববাংলার মানুষ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত নীরবই থেকে গেছে।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি সত্য যে, ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব এসে গেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তিনি তার আত্মজীবনীতে যুবলীগের ভাঙন এবং সেখানে থেকে বের হয়ে আসার বিবরণ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুর হক হলে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গড়ে তোলার বিবরণও প্রদান করেন। পাকিস্তানের প্রচলিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ধারাবাহিকতা ভেঙে প্রথম গড়ে তোলা হয় ছাত্রলীগ। ১৫০ মোগলটুলীতে অবস্থিত যুবলীগের অফিসে যুবলীগকে আর ঠাঁই দেয়া হয়নি সেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সঙ্গীদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ছাত্রলীগের নাম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ করার ক্ষেত্রে অলি আহাদ আপত্তি করেন। তার মতে, মুসলিম শব্দটি রাখা উচিত নয়। কোনো সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হওয়াটা অবাঞ্ছিত বলে তিনি মনে করেন। জাতির পিতা অলি আহাদকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে এখনই মুসলিম (১৯৪৮ সালে) শব্দ বাদ দেয়ার সময় হয়নি। তিনি অলি আহাদকে বললেন, ‘এখনো সময় আসেনি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।’ এই একটি অনুচ্ছেদ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু কখনো জনগণকে পেছনে ফেলে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো রাজনীতি করেননি। দ্বিতীয়ত তিনি অনুভব করেন নাম যাই হোক নীতি ও আদর্শ ঠিক থাকলে নাম বদলানোটা কোনো বিষয় নয়।

বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি বস্তুত তার সামগ্রিক রাজনৈতিক ভাবনাকে প্রকাশ করে। আমরা কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াও এটি স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারি যে ১৯৪৮ সালের শুরুতেই তিনি এটি বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য নয়। সে জন্যই তার ভাবনায় তিনি ভাবেন যে বাঙালিদের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে জন্য তিনি একদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতিও গড়ে তুলেছেন। তবে তার লড়াইটি হঠকারী ছিল না। ফলে তিনি কেবলমাত্র সশস্ত্র আন্দোলনের কথা ভাবেননি। সেই ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গড়ে তোলার সময় ধারণা করেছিলেন যে, আগে মানুষকে প্রস্তুত করতে হবে তারপর একটি অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে আরো একটি বিষয় উল্লেখ আছে যে, তৎকালে অলি আহাদদের মতো যারা যুবলীগ করার নামে উগ্র কমিউনিজম বা উগ্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতেন, আজ তারা দেখুন প্রমাণিত হয়েছে যে প্রচলিত রুশ-চীনপন্থি কমিউনিজম দুনিয়াতে টিকে থাকতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করে সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় তার নিজের মতবাদ তুলে ধরেন।

তার পুরো জীবনটা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তিনি একদিকে নির্বাচন করেছেন, অন্যদিকে আমাদের কণ্ঠে বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর সেই স্লোগানও তুলে দিয়েছেন। বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বুঝতে হলে তার ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা ছাত্রলীগের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। এরপর দেখতে হবে মুসলিম লীগ থেকে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে তোলার কথা। তারপর এটিও লক্ষ করতে হবে যে দুটি সংগঠনের নাম থেকেই মুসলিম শব্দ প্রত্যাহার। বাংলাদেশ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা কেউ যদি অবলোকন করেন তবে অনুভব করবেন যে, পাকিস্তানকে প্রথম প্রতিবাদের মুখোমুখি করান তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের জন্মের পরপরই বঙ্গবন্ধু কী ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়েন তার প্রথম নমুনাটি পাওয়া যায় তার ও ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা লাগানো, মোগলটুলীর অফিস তছনছ করা ও ছাত্রলীগকে দমন করার সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে। তবে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ গঠন করে ব্যাপক সাড়া পান।

পাকিস্তান সরকার ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দেয়ার ফলে তরুণদের বিক্ষোভ বাড়তে থাকে ও ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে স্পষ্ট করে বাংলাদেশ গড়ে তোলার গোড়ার কথাটি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান হওয়ার পর পাঞ্জাব বা সিন্ধুর মুসলিম লীগ না ভাঙলেও বাংলার মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ভেঙে যায়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত মুসলিম লীগের টুকরা যে টেনে টেনে চলতে থাকে সেটিও জানা যায়। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম সিঁড়িটির সূচনা পাওয়া যায় ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ৯১ পৃষ্ঠায় আছে, ‘ফেব্রুয়ারি ৮ হবে ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধানে সংবিধান সভার (কনস্টিটিউট এসেম্বলির) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেটিও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যের সেই মত।’

অনুভব করা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের যেসব সদস্য রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে ছিলেন তারা কুলাঙ্গার। নোয়াখালীর কবি আব্দুল হাকিমের ভাষায় ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ তবে এই বঙ্গে কেবল কুলাঙ্গাররাই জন্মায়নি- জন্মেছেন জাতীয় বীরেরাও। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ৯১ পৃষ্ঠাতেই আছে, কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হলো বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম বিশাল ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় (কমিটি) করা হয়েছে। তমদ্দুন মজলিশ একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব। এদিকে পুরনো লীগ (মুসলিম লীগ) কর্মীদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যোগ দিলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে বাংলা ভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। (৯২ পৃষ্ঠা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)
যারা এখনো ভাবেন যে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে রাগ করে বা বৈষম্যের জন্য বাংলাদেশ তৈরি করেছি তারা অনুগ্রহ করে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনটির প্রতি নজর দেবেন। মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই করে যারা পািকস্তানের জন্য দরদি হয়ে যান তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাঙালিদের মুসলমান বলেই গণ্য করেনি এবং বাংলাদেশের মুসলমানরা তথাকথিত পাকিস্তানের হায়েনাদের সব প্রকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

১১ মার্চ বাংলা ভাষা দিবস ঘোষণা করার পর বঙ্গবন্ধু জেলায়, মহকুমায় বেরিয়ে পড়েন। তিনি ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে সভা করে দিনটির তিনদিন আগে ঢাকা ফিরে আসেন। তিনি স্মরণ করেন যে, দৌলতপুরে মুসলিম লীগাররা বঙ্গবন্ধুর সভায় মারপিট করার চেষ্টা করে। তারপরও তিনি সেখানে বক্তৃতা করেন।

বঙ্গবন্ধু ১১ মার্চের যে বিবরণ প্রদান করেন তা এমন, ‘১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্র-কর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হলো না। সব ঢাকা শহর পোস্টারিংয়ে ভরে ফেলা হলো। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল। কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরোপুরি হরতাল পালন করেনি। সকাল ৮টায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ করা হয়। একদল মার খাবার পর আরেক দল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল।… আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটেছি। এর মধ্যে শামসুল সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য সিটিএসপি জিপ নিয়ে বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। ….আমাদের ওপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল। এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। …আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাটি যদি না জানেন তবে মনেই হতে পারে কেবল সুইচ টিপে দেশটা স্বাধীন হয়েছে এবং এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে উঠছে।
পাঁচ
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে ভাষার দাবি এবং মার্চে ভাষা দিবস পালন করার মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি একটি নতুন জাতিসত্তা গড়ে তোলার শুভ সূচনা করে। ১৯৪৭-এর পাক-ভারত বিভাজনের আগে রাজনৈতিক ইস্যুটি ছিল হিন্দু-মুসলমানের। পূর্ববঙ্গে হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার এবং এক শ্রেণির হিন্দুর জাতপ্রথা ও মুসলিম বিদ্বেষ এমন একটি অবস্থা তৈরি করেছিল যে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে অবিভক্ত ভারতে মুসলিমদের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। কিন্তু ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতেই পাকিস্তানিরা তাদের কুৎসিত চেহারা দেখাতে শুরু করে। ভাষা দিবসে জাতির পিতাসহ বাঙালি নেতারা গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু সেই সময়ের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, “তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। শোভাযাত্রা রোজই বের হচ্ছিল। নাজিমুদ্দীন সাহেব বেগতিক দেখলেন। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ওয়াদুদ ও বখতিয়ার দুজনই ছাত্রলীগ কর্মী, তাদের ভীষণভাবে আহত করে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এই সময় শেরে বাংলা, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর সাহেব, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ও আরো অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন। আবার শহীদ সাহেবের দল এক হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দীন সাহেব ঘাবড়িয়ে গেলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করতে রাজি হলেন।
আমরা জেলে, কি আলাপ হয়েছিল জানি না। তবে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব জেলে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন, নাজিমুদ্দীন সাহেব এই দাবিগুলি মানতে রাজি হয়েছেন; এখনই পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা বাংলা করে ফেলবে। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা থেকে সুপারিশ করবেন, যাতে কেন্দ্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সমস্ত মামলা উঠিয়ে নিবেন, বন্দিদের মুক্তি দিবেন এবং পুলিশ যে জুলুম করেছে সেই জন্য তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। আর কি কি ছিল আমার মনে নাই। তিনি নিজেই হোম মিনিস্টার, আবার নিজেই তদন্ত করবেন এ যেন এক প্রহসন।
আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, ‘হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।’
আমাদের ১১ তারিখে জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় কারাগারের ভিতর একটা গোলমাল হয়। একজন অবাঙালি জমাদার আমাদের ওয়ার্ডে তালা বন্ধ করতে এসেছেন। আমরা আমাদের জায়গায় এই সময় বসে থাকতাম। জমাদার সাহেব এক দুই গণনা করে দেখতেন, আমরা সংখ্যায় ঠিক আছি কি না। হিসাব মিললে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিতেন। সন্ধ্যার সময় জেলখানার সমস্ত কয়েদিদের গণনা করে বাইরে থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্ধ করা হয়। জমাদার কয়েকবার গণনা করলেন, কিন্তু হিসাব ঠিক হচ্ছে না। পাশের আরেকটা রুমেও আমাদের কিছু ছাত্র ছিল, তাদের গণনা ঠিক হয়েছে। ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্র ছিল, তারা কারও কথা শুনতে চাইত না। গণনার সময় এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেত। আমি ও শামসুল হক সাহেব সকলকে ধমকিয়ে বসিলে রাখতাম। আমরা দুইজন ও আবদুল মান্নান (এখন নবকুমার হাইস্কুলের হেডমাস্টার) এই তিনজনই একটু বয়সে বড় ছিলাম। খাওয়ার ভাগ-বাটোয়ারার ভাগ মান্নান সাহেবের উপরই ছিল। হিসাব যখন মিলছে না তখন জমাদার সাহেব রাগ করে ফেললেন এবং কড়া কথা বললেন। এতে ছাত্ররা ক্ষেপে জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল এবং হৈচৈ শুরু করল। আমি ও হক সাহেব আবার সকলকে এক জায়গায় বসিয়ে দিলাম। জমাদার সাহেব গণনা করলেন এবং হিসাব মিলল। কিন্তু দরজার বাইরে যেয়ে তিনি হঠাৎ বাঁশি বাজিয়ে দিলেন এবং পাগলা ঘণ্টা বেজে গেল। পাগলা ঘণ্টার অর্থ বিপদ সংকেত। এ অবস্থায় জেল সিপাহিরা যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, বন্দুক-লাঠিসোটা নিয়ে ভিতরে আসে এবং দরকার হলে মারপিট শুরু করে। এই সময় আইন বলে কিছুই থাকে না। সিপাহিরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, যদিও সুবেদার হাওলাদার তাদের সাথে থাকে। জেলার ও ডেপুটি জেলার সাহেবরাও ভিতরের দিকে ছুটতে থাকেন।
আমরা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, কি হয়েছে। যে বাঙালি সিপাহি আমাদের ওখানে ডিউটিতে ছিল সে তালা বন্ধ করে ফেলেছে। জমাদার তার কাছে চাবি চাইল। সে চাবি দিতে আপত্তি করল। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলো, আমরা দেখতে পেলাম। সিপাহি চাবি নিয়ে এক দৌড়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে গেল। জমাদারের ইচ্ছা ছিল দরজা খুলে সিপাহিদের নিয়ে ভিতরে ঢুকে আমাদের মারপিট করবে। জেলার, ডেপুটি জেলার বা সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব ভিতরে আসবার পূর্বেই আমরা বুঝতে পেরে সকলকে তাড়াতাড়ি যার যার জায়গায় বসতে বলে শামসুল হক সাহেব ও আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের না মেরে ভিতরে যেন কেউ না আসতে পারে এই উদ্দেশ্যে। এ কথাও সকলকে বলে দিলাম যে, আমরা মার না খাওয়া পর্যন্ত কেউ হাত তুলবে না। যদি আমাদের আক্রমণ করে এবং মারপিট করে তখন টেবিল, চেয়ার, থালা, বাটি যা আছে তাই দিয়ে প্রতিরোধ করত হবে। হক সাহেব ও আমি দুইজনই একগুঁয়ে ছিলাম।
দরকার হলে সমানে হাতও চালাতে পারতাম, আর এটা আমার ছোট্টকাল থেকে বদ অভ্যাসও ছিল। সিপাহি যদি চাবি না নিয়ে ভাগত তবে আমাদের মার খেতে হত, সে সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল না। কারণ, আমরা তো একটা রুমে বন্ধ। এর মধ্যে বহু সিপাহি চলে এসেছে, তারা অসভ্য ভাষায় গালাগালি করছিল। এমন সময় জেলার সাহেব ও ডেপুটি জেলার জনাব মোখলেসুর রহমান আমাদের গেটে এসে দাঁড়িয়ে সিপাহিদের নিচে যেতে হুকুম দিলেন। কিছু সময়ের মধ্যে জেল সুপারিনটেনডেন্ট মি. বিলও এসে হাজির হলেন এবং ঘটনা শুনে সিপাহিদের যেতে বললেন। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবকে শামসুল হক সাহেব সমস্ত ঘটনা বললেন। এই বিল সাহেবই ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দিদের উপর গুলি করে কয়েকজন দেশপ্রেমিককে হত্যা করেছিলেন। পরে আমরা বুঝতে পারলাম একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমাদের মারপিট করার জন্য। পরের দিন ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের জেলের আইনকানুন ও নিয়ম সম্বন্ধে অনেক কিছু বললেন। আমি যদিও কয়েকদিন হাজত খেটেছিলাম ছোটবেলায়, তবু জেলের আইনকানুন কিছুই বুঝতাম না, আর জানতাম না। দু’একখানা বই পড়ে যা কিছু সামান্য জ্ঞান হয়েছিল জেল সম্বন্ধে। এ কথা সত্য, আইনকানুন ছাত্ররা একটু কমই মানত জেলখানায়। শামসুল হক সাহেব, মান্নান সাহেব ও আমি- এই তিনজনই সকলকে বুঝিয়ে রাখতাম। এদের মধ্যে অনেকে স্কুলের ছাত্রও ছিল। নয় কি দশ বছরের একটা ছেলেও ছিল আমাদের সাথে। তার বাবা তার সাথে জেলগেটে দেখা করতে এসেছিল এবং তাকে বলেছিল, ‘তোকে আজই বের করে নিব’। ছেলেটা তার বাবাকে বলেছিল, ‘অন্যান্য ছাত্রদের না ছাড়লে আমি যাব না’। সে যখন এই কথা ফিরে এসে আমাদের বলল, তখন সকলে তাকে আদর করতে লাগল এবং তার নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিল। তার নাম আজ আর আমার মনে নাই, তবে কথাগুলো মনে আছে। ভীষণ শক্ত ছেলে ছিল। গ্রেপ্তারকৃত একজন ছাত্রেরও মনোবল নষ্ট হয় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোনো ত্যাগ তারা স্বীকারে প্রস্তুত ছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠা) অতি সহজ-সরল ভাষায় জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নটির যে বিবরণ প্রদান করেছেন তাতে একদিকে যেমন করে বাংলার তরুণ-যুবার অসাধারণ মনোবলের পরিচয় পাওয়া যায় অন্যদিকে তেমনি বাংলার মেয়েরা, স্কুলপড়ুয়া বালকদের অসাধারণ দেশপ্রেমের বিবরণ পাওয়া যায়। কারাগারের যে বাঙালি রক্ষী চাবি নিয়ে নিচে নেমে এসেছিলেন তার প্রচ্ছন্ন দেশপ্রেম মুগ্ধ করার মতো যেমনি স্কুলপড়ুয়া বালক তার সঙ্গে জেলে থাকা রাজবন্দিদের মুক্তি না দিলে সে নিজেও জেলের বাইরে যেতে চায় না বলে যে দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়েছে তা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের ধন।
আমরা যদি সিক্রেটস ডকুমেন্টসের প্রথম খণ্ডটি দেখি তবে তাতেও দেখতে পাই যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায় ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতেই। ১৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ উপস্থাপিত পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয় যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশিত একটি পুস্তিকা ‘পূর্ব্ব পাকিস্তানে দুর্ভাগা জনসাধারণ কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের দাবী’ মূল্য ৩ টাকা বর্ধমান হাউসের সামনে বিলি/বিক্রি করা হয় (পৃষ্ঠা ৪)। বস্তুত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু ও তার সাথীরা যে নিজস্ব ধারার রাজনীতি গড়ে তুলেন এবং সেটি যে পাকিস্তানের মূল রাজনীতির ভিত্তিতে ভিন্নতা আনতে শুরু করে সেটি আঁচ করতে এমনকি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরও কিছু বাকি থাকেনি। মার্চের ভাষা আন্দোলনে বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও অংশগ্রহণ পাকিস্তানি শাসকদের ভীত করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর জবানিতেই আমরা সামনে জানতে পারব বাংলা ভাষা আন্দোলন কোন পথ ধরে সামনে এগিয়ে যায়। আমরা এটিও অনুভব করব যে বাংলা ভাষার আন্দোলনই ছাত্রলীগের গণভিত্তি তৈরি করে এবং মুসলিম লীগের রাজনীতিকে বাংলায় শেকড়সহ উপড়ে ফেলা হয়।
ছয়
আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই ইতিহাস লিখেছেন। যারা অংশ নিয়েছেন তারাও সেই আন্দোলনের বিবরণ দিয়েছেন। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এই সম্পর্কে সবচেয়ে সঠিক বিবরণটি রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চের বিবরণটি জাতির পিতার স্মৃতি থেকে পাঠ করা যেতে পারে। ১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সবাই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সবাই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপস হয়েছে তার সবই সভায় অনুমোদন করা হলো। তবে সভা খাজা নাজিমুদ্দীন যে পুলিশি জুলুমের তদন্ত করবেন, তা গ্রহণ করল না; কারণ খাজা সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি বক্তৃতায় বললাম, ‘যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা গ্রহণ করা উচিত। শুধু আমরা ওই সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে পারি, এর বেশি কিছু না।’ ছাত্ররা দাবি করল, শোভাযাত্রা করে আইন পরিষদের কাছে খাজা সাহেবের কাছে এই দাবিটা পেশ করবে এবং চলে আসবে। আমি বক্তৃতায় বললাম, তার কাছে পৌঁছে দিয়েই আপনারা আইনসভার এরিয়া ছেড়ে চলে আসবেন। কেউ সেখানে থাকতে পারবেন না। কারণ সংগ্রাম পরিষদ বলে দিয়েছে, আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে কিছুদিনের জন্য। সবাই রাজি হলেন।
এ শোভাযাত্রা করে আমরা হাজির হয়ে কাগজটা ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম খাজা সাহেবের কাছে। আমি আবার বক্তৃতা করে সবাইকে চলে যেতে বললাম এবং নিজেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসার জন্য রওনা করলাম। কিছু দূর এসে দেখি, অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। কিছু ছাত্র ও জনসাধারণ তখনো দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে স্লোগান দিচ্ছে। আবার ফিরে গিয়ে বক্তৃতা করলাম। এবার অনেক ছাত্রও চলে গেল। আমি হলে চলে এলাম। প্রায় চারটায় খবর পেলাম, আবার বহু লোক জমা হয়েছে, তারা বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী ও জনসাধারণ, ছাত্রমাত্র কয়েকজন ছিল। শামসুল হক সাহেব চেষ্টা করছেন লোকদের ফেরাতে। মাঝে মাঝে হলের ছাত্ররা দুয়েকজন এমএলএকে ধরে আনতে শুরু করেছে মুসলিম হলে। তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিচ্ছে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারেন, তবে পদত্যাগ করবেন। মন্ত্রীরাও বের হতে পারছেন না। খাজা সাহেব মিলিটারির সাহায্যে পেছন দরজা দিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন। বহু লোক আবার জড়ো হয়েছে। আমি ছুটলাম অ্যাসেম্বলির দিকে। ঠিক কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছি তখন লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে শুরু করেছে পুলিশ। আমার চক্ষু জ্বলতে শুরু করেছে। পানি পড়ছে, কিছুই চোখে দেখি না। কয়েকজন ছাত্র ও পাবলিক আহত হয়েছে। আমাকে কয়েকজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে-মুখে পানি দিতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে একটু আরাম পেলাম। দেখি মুসলিম হলে হৈচৈ। বাগেরহাটের ডা. মোজাম্মেল হক সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি এমএলএ। তাঁকে ছাত্ররা জোর করছে লিখতে যে, তিনি পদত্যাগ করবেন। আমাকে তিনি চিনতেন, আমিও তাঁকে চিনতাম। আমি ছাত্রদের অনুরোধ করলাম, তাঁকে ছেড়ে দিতে। তিনি লোক ভালো এবং শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। অনেক কষ্টে, অনেক বুঝিয়ে তাঁকে মুক্ত করে বাইরে নিয়ে এলাম। একটা রিকশা ভাড়া করে তাঁকে উঠিয়ে দিলাম। হঠাৎ খবর এলো, শওকত মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটলাম তাকে দেখতে। সত্যই সে হাতে, পিঠে আঘাত পেয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাকে মেরেছে। আরো কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছে। সবাইকে বলে আসলাম, একটু ভালো হলেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে। কারণ পুলিশ আবার গ্রেপ্তার করতে পারে।
সন্ধ্যার পরে খবর এলো ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা হবে। ছাত্ররাও উপস্থিত থাকবে। আমার যেতে একটু দেরি হয়েছিল। তখন একজন বক্তৃতা করছে আমাকে আক্রমণ করে। আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার বক্তৃতা শেষ হলে আমার বক্তব্য বললাম। আমি যে আমতলায় ছাত্রসভায় বলেছিলাম, কাগজ দিয়েই চলে আসতে এবং অ্যাসেম্বলি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে চলে যেতে অনুরোধ করেছিলাম এবং বক্তৃতাও করেছিলাম, এ কথা কেউ জানেন কিনা? যা হোক, এখানেই শেষ হয়ে গেল, আর বেশি আলোচনা হলো না এবং সিদ্ধান্ত হলো আপাতত আমাদের আন্দোলন বন্ধ রাখা হলো। কারণ কয়েক দিনের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসবেন পাকিস্তান হওয়ার পরে। তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে হবে। আমরা ছাত্ররাও সংবর্ধনা জানাব। প্রত্যেক ছাত্র যাতে এয়ারপোর্টে একসঙ্গে শোভাযাত্রা করে যেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না। ফরিদপুর ও যশোরে কয়েকশ ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিল। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর ও আরো অনেক জেলায় আন্দোলন হয়েছিল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছিল এই আন্দোলনকে বানচাল করতে, কিন্তু পারেনি। এই আন্দোলন ছাত্ররাই শুরু করেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আন্দোলনের পরে দেখা গেল জনসাধারণও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বদ্ধপরিকর- বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরাও একে সমর্থন দিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একদল গুণ্ডা আক্রমণ করলে পলাশী ব্যারাক থেকে সরকারি কর্মচারীরা এসে তাদের বাধা দিয়েছিল। যার ফলে গুণ্ডারা মার খেয়ে ভাগতে বাধ্য হয়েছিল। পরে দেখা গেল, ঢাকা শহরের জনসাধারণের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সরকার থেকে প্রপাগান্ডা করা হয়েছিল যে, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা পায়জামা পরে এসে এই আন্দোলন করছে। যে সত্তর-পঁচাত্তর জন ছাত্র বন্দি হয়েছিল তার মধ্যে একজনও হিন্দু ছাত্র ছিল না। এমনকি যারা আহত হয়েছিল তার মধ্যেও একজন হিন্দু ছিল না। তবু তখন থেকেই ‘যুক্ত বাংলা ও ভারতবর্ষের দালাল, কমিউনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী’- এই কথাগুলো বলা শুরু হয়, আমাদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে। এমনকি সরকারি প্রেসনোটেও আমাদের এভাবে দোষারোপ করা হতো।
বঙ্গবন্ধুর এই বিবরণ থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র এবং হিন্দুদের কর্মকাণ্ড বলে যে অপপ্রচার চালিয়েছিল সেটির জন্ম ১৯৪৮ সালেই। আমরা দুষ্কৃতকারী হিসেবে তখন থেকেই পরিচিত হয়ে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু এরপর তার জবানিতে বাঙালির সহনশীলতার ও যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ার ঐতিহাসিক মানসিকতার বিষয়টি প্রকাশ করেন।
বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কী করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারেনি। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করেনি। এই সময় সরকারদলীয় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুর জন্য জানমাল কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে পড়েছিলেন। তারা শেষ ‘তাবিজ’ নিক্ষেপ করলেন। জিন্নাহকে ভুল বোঝালেন। এরা মনে করলেন, জিন্নাহকে দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলাতে পারলেই আর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পাবে না। জিন্নাহকে দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর যে কোনো ন্যায়সঙ্গত কথা মানতে সবাই বাধ্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কোন পথে, তাঁকে কেউই তা বলেন নাই বা বলতে সাহস পাননি।
১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লোক তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁও হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সবাই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভেজা কাপড় নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার-পাঁচশ ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’- তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না’। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনোদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।
ঢাকায় জিন্নাহ দুই দলের ছাত্রনেতাদের ডাকলেন। বোধহয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদেরও ডেকেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের দুইজন করে প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করলেন। কারণ তিনি পছন্দ করেন নাই, দুইটা প্রতিষ্ঠান কেন হবে এই মুহূর্তে! আমাদের পক্ষ থেকে মিস্টার তোয়াহা আর শামসুল হক সাহেব ছিলেন, তবে আমি ছিলাম না। জিন্নাহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা পছন্দ করেছিলেন। নিখিল পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নাম যখন আমাদের প্রতিনিধি পেশ করেন, তখন তাঁরা দেখিয়ে দিলেন যে, এদের অধিকাংশ এখন চাকরি করে, অথবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন জিন্নাহ তাদের ওপর রাগই করেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সঙ্গে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়ে- শামসুল হক সাহেব আমাকে এসে বলেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সৎ সাহস ছিল, সত্য কথা বলতে কাউকেও ভয় পেতেন না।
জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিল, তার নাম আমার মনে নেই। তবে সে বলেছিল ‘জিন্নাহ যা বলবেন, তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে।’ আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজো আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।’ সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সব কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না। উপরোক্ত বিবরণ থেকে আমরা স্পষ্টতই বাঙালির জাতির পিতার রাজনৈতিক জন্ম হতে দেখি।

SUMMARY

2600-বঙ্গবন্ধু৪.jpg