মুজিবদর্শনের সারাৎসার

শেখ মুজিবের প্রবচন: মুজিবদর্শনের সারাৎসার

মোনায়েম সরকার 

আমি দীর্ঘদিন ধরেই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি করছি। আমার সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ড ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আরো কিছু বই প্রকাশ করে দেশ-বিদেশের নামি-দামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেকোনো লেখাই আমি খুব আগ্রহ ভরে পড়ি। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের লেখকদের লেখা আমি আন্তরিকভাবেই পাঠ করি। সেই অভ্যাসের সূত্র ধরেই পাঠ করি ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’ গ্রন্থটি। বলতে দ্বিধা নেই- এই গ্রন্থটি থেকে আমি যা প্রত্যাশা করিনি তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু প্রাপ্তি ঘটেছে। মুজিবদর্শনের ভ‚মিকাগ্রন্থ হিসেবে ছোট্ট বুকে উক্ত গ্রন্থটি মুজিবদর্শনকে যথার্থভাবে ধারণ করেছে বলেই আমি মনে করি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশে-বিদেশে নানা আয়োজন চলছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্মশতবর্ষে বিশ্বব্যাপী সাড়া পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে আমার কাছেও দেশ-বিদেশের আট-দশজন পিএইচডি-গবেষক এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে। যে মানুষের জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না, বাঙালি জাতি স্বাধীন ভূখণ্ডের অধিকার পেত না- তার জন্মশতবর্ষ একটু আলাদা মর্যাদাই আমাদের কাছে দাবি করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নানামুখি কর্মকাণ্ড সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বই প্রকাশ ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

পূর্বেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি বেশকিছু কাজ করেছি এবং এখনো করছি। দীর্ঘদিন ধরেই আমি লক্ষ করছি- বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস থাকলেও তাঁর দর্শন উপলব্ধি করে নতুন কিছু করার আগ্রহ আমাদের কম। যারা নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন- তাদের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়।

আমাকে বলতেই হবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি অসামান্য কাজ করেছেন লেখক-গবেষক-অধ্যাপক সৈয়দ জাহিদ হাসান। তার গ্রন্থের নাম ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’। সৈয়দ জাহিদ হাসান পরিশ্রমী গবেষক। তার গবেষণা কর্মের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

‘শেখ মুজিবের প্রবচন’ গ্রন্থটি একেবারেই অভিনব একটি গ্রন্থ। এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে একমাত্র মাও সে তুংয়ের ‘রেড বুক’ গ্রন্থটি। আজ মাও সে তুংয়ের ‘রেড বুক’ খুব একটা চোখে পড়ে না, তবে শেখ মুজিবের প্রবচন’ যে অনন্তকাল টিকে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’ গ্রন্থটির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই গ্রন্থটির আকার-আকৃতি যেমন চমকপ্রদ, বিষয়-বিন্যাসও অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও অভিনব। এই গ্রন্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয অংশ হলো গ্রন্থটির ‘ভ‚মিকা’। অত্যন্ত সুলিখিত তথ্যবহুল ভ‚মিকাটি না পড়লে বোঝাই যাবে না গ্রন্থটির নামকরণ কেন ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’।
শেখ মুজিবের রচনা সম্ভার বিশাল না হলেও ক্ষুদ্র নয়। তার ভাষণ-বিবৃতি, সাক্ষাৎকার সেই সঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’- এসব মিলিয়ে দেখলে শেখ মুজিবের রচনাবলি আসলেই বৃহৎ আকার ধারণ করবে। শেখ মুজিবের সকল ভাষণ-বিবৃতি-সাক্ষাৎকার ও মূল্যবান গ্রন্থ দুটি থেকে সৈয়দ জাহিদ হাসান সংগ্রহ করেছেন অসংখ্য সুভাষিত উক্তি। এই উক্তিগুলো তিনি এলোমেলোভাবে বিন্যাস না করে অধ্যায় ভিত্তিক বিন্যাস করে নিজস্ব বিশ্লেষণ যুক্ত করেছেন। প্রয়োজনে তুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতিও গ্রহণ করেছেন।

‘শেখ মুজিবের প্রবচন’-এর আরো একটি অভিনবত্ব হলো ব্যক্তিসূচি ও নির্ঘণ্ট সংযুক্তি। ব্যক্তিসূচিটি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়েছে এ ক্ষেত্রে। নির্ঘণ্টটিও দরকার ছিল। কারণ সূচিপত্রে যেহেতু সবকিছু স্পষ্টভাবে বলা যায় না, তাই নির্ঘণ্ট যুক্ত করলে পাঠক অনেক কিছুই সহজে অনুধাবন করতে পারেন।

সৈয়দ জাহিদ হাসান যেহেতু শিল্প-সাহিত্য-দর্শন বিবেচনায় রেখে গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন, সেই হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গিও সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছে বলেই মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি সকল শ্রেণির পাঠকের জন্যই আনন্দের উৎস হবে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তিনি বয়সের তুলনায় অভিজ্ঞতা একটু বেশিই লাভ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতাই বঙ্গবন্ধুকে মহান মানুষে পরিণত করতে সাহায্য করে। বাঙালি জাতিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক অহংকার করতেন। আবার তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড দেখে তিনি হতাশাও ব্যক্ত করতেন। তবে বাঙালিকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন বলেই প্রতীয়মান হয়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় অত্যন্ত ভালোবাসি’- এমন আবেগ কেবল বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই দেখানো সম্ভব- আর কোনো বঙ্গনেতা এ কথা বলেছেন কিনা জানি না।

বঙ্গবন্ধু জেল খেটেছেন, কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু এটা বোধহয় আমরা অনেকেই জানি না যে, জেলে থেকে বঙ্গবন্ধু কিছু অন্যরকম অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলোর কথা কখনোই আমরা জানতে পারতাম না- যদি জেলে বসে বঙ্গবন্ধু তাঁর জেলজীবনের কথা লিখে না যেতেন। ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’ গ্রন্থে আমরা এমন অনেক কথাই পাবো- যে কথাগুলো হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলার সংস্কৃতি-সভ্যতা-জাতীয়তাবাদ- এসবই বঙ্গবন্ধু অবিচল নিষ্ঠায় ধারণ ও বহন করেছেন।

শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আমার জানা মতে এ পর্যন্ত যত কাজ হয়েছে, তার মধ্যে সৈয়দ জাহিদের কাজটি শুধু ব্যতিক্রমধর্মী নয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়ও বটে। লেখক বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের মৌখিক ও লিখিত সাহিত্যকর্ম থেকে যুগোত্তীর্ণ প্রবচনগুলো সংকলন করে শেখ মুজিবের প্রবচন গ্রন্থটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। ছয়টি অধ্যায়ে গ্রন্থটি বিন্যস্ত করে তেরোটি বিষয় কেন্দ্রে রেখে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন তুলে ধরা হয়েছে। যেখান থেকে যে-প্রবচন উৎকলন করেছি প্রত্যেকটি প্রবচনেরই উৎস নির্দেশ করেছি। শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবচনই এত দিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের সৃজিত সাহিত্য যে কত গভীর ও বৈচিত্র্যময় তার কিছুটা হলেও শেখ মুজিবের প্রবচন গ্রন্থটি উপলব্ধি করাতে সক্ষম হবে। এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের একটি সুশৃঙ্খল-গবেষণা গ্রন্থের শূন্যতা পূরণ হলো বলেই আমি বিশ্বাস করি।’ আসলেই তাই, এই গ্রন্থের ১৮৯টি প্রবচন অনেক কথাই ধারণ করেছে।

প্রত্যেক লেখকই একটি বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর গ্রন্থটির সজ্জা বিন্যাস করেন। ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’ গ্রন্থটিও নিশ্চয়ই সুপরিকল্পনার ফসল। তবে এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর চিঠির কোনো উল্লেখ নেই, থাকলে বোধহয় আরেকটু ভালো হতো। তাছাড়া পরিশিষ্ট যুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর হস্তাক্ষর সংবলিত বিশেষ কিছু নমুনালেখাও সন্নিবেশিত করা যেত। তাহলে গ্রন্থটি আরো ভালো হতো। তবে সৈয়দ জাহিদ হাসান যেহেতু শিল্প-সাহিত্য-দর্শন বিবেচনায় রেখে গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন, সেই হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গিও সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছে বলেই মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি সকল শ্রেণির পাঠকের জন্যই আনন্দের উৎস হবে। বঙ্গবন্ধু বড় মাপের নেতা ছিলেন এ কথা সত্য কিন্তু সৈয়দ জাহিদ হাসানের ‘শেখ মুজিবের প্রবচন’ গ্রন্থটি আমাকে আরো একটি নতুন তথ্য পরিবেশন করল- সেটা হলো সাহিত্যিক-দার্শনিক হিসেবেও বঙ্গবন্ধুর তুলনা তিনি নিজেই।

সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১২, ২০২০ 

SUMMARY

2596-১.jpg