ফরিদ আহমদ দুলাল
মানুষের বুকের গহিনে যখন কারো অধিষ্ঠান হয়ে যায়, তখন তিনি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠেন। বাঙালির মহান নেতা যেমন জাতিকে স্বাধিকার আর স্বশাসিত হবার স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন নিজের বিশ্বাস-প্রেম-নিষ্ঠা আর সততায়, তেমনি নিজেকেও বাঙালি জাতির অনিবার্য-অবিসংবাদিত নেতা হিসেবেও প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের একাগ্রতা-নিবেদন আর ত্যাগে। আমরা তাঁর জীবনসংগ্রামকে পর্যালোচনা করলে দেখি ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হবার পর পূর্ববাংলার মানুষের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দুঃশাসন, মুসলিম লীগের বাঙালিবিদ্বেষ; তখন থেকেই তরুণ বাঙালি রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিবের বাঙালিপ্রীতি-বাংলা প্রীতি এবং পূর্ববঙ্গ প্রীতি। ১৯৫৩-৫৪-তে শেখ মুজিব বাঙলির কাছে প্রিয় নেতা, ক্রমেই জনপ্রিয়; ১৯৬৬-তে যখন শেখ মুজিব বাঙালি জাতির মুক্তিরাকাক্সক্ষায় ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন, এরপর তিনি রাতারাতি পাকিস্তানি দুঃশাসনের শিরপীড়ার কারণ আর বাঙালির স্বপ্নাকাক্সক্ষার ধন। পাকিস্তানি দুঃশাসন যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে প্রতিহত এবং চিরতরে স্তব্ধ করতে ষড়যন্ত্রে পা বাড়াল, শেখ মুজিব তখন হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিষ্কৃতি লাভ এবং কারামুক্ত হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স মাঠে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সমাবেশে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়; এরপর শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ৮ মার্চ ঢাকা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হলে শেখ মুজিব বাংলাদেশের সর্বব্যাপী হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশা। আমরা তাই প্রত্যক্ষ করি, ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসকাল বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও বাংলাদেশ তাঁর নামে, তাঁকে নিজেদের পাশে চেতনায় ধারণ করেই যুদ্ধ করেছে হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু মুজিব, সেই যে বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদে সর্বব্যাপী হলেন; এরপর শেখ মুজিব মুক্তিকামী বাঙালির চৈতন্যে নিত্য নাড়া দিয়ে যান। বাংলার কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে-মাঝি-মাল্লা-কৃষানি-ছাত্র-যুবক-দরিদ্র-নিঃস্ব-ধনী-নির্ধন সবার তিনি প্রাণের মানুষ, যখন তাঁকে নিয়ে বাঙালির নিত্য প্রাণোচ্ছ্বাস; তখন বাংলার ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর নিত্য উপস্থিতি-নিত্য অরতি। ১৯৭১-এর যুদ্ধের দিনগুলোর কথা যাদের স্মরণে আছে, তাঁরা মানবেন, যুদ্ধচলাকালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধের খবর জানতে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী কলকাতা, বিবিসি এবং ভয়েজ অব আমেরিকার ওপর নির্ভর করতেন। ঢাকা রেডিও প্রচুর মিথ্যাচার করত এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও অনেক ভুল তথ্য এবং কুৎসা প্রচার করত। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি, এ কথা স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র কখনো সরাসরি বলত না; বাংলাদেশের মানুষও বিশ্বাস করতে চাইত বঙ্গবন্ধুই যুদ্ধের নেতৃত্বে আছেন, নেপথ্যে থেকে তিনিই সব নির্দেশনা দিচ্ছেন। সবাই হয়তো বুঝতেন বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়েছেন, কিন্তু নিজেদের মনোবল ধরে রাখতেই সবাই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত ভাবতে চাইতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার যখন গঠিত হয়, তখন বঙ্গবন্ধুকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হয়, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা হয়। বঙ্গভূমির মাটি ও মানুষের সঙ্গে শেখ মুজিব গড়ে তুলেছিলেন নিবিড় সখ্য। বাঙালিকে স্বপ্নের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে তিনি যাপিত জীবনে ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। বর্তমান আলোচনায় ময়মনসিংহ জনপদে বঙ্গবন্ধুর আগমন এবং আগমনের কার্যকারণ উন্মোচনে সচেষ্ট হবো এবং একই সঙ্গে প্রত্যাশা ব্যক্ত করব দেশের অন্যান্য জনপদে তাঁর যোগাযোগের বার্তা পাবার; আমার বিশ্বাস বিভিন্ন জনপদে তাঁর যোগাযোগের তথ্যযোগে আগামী প্রজন্ম উপলব্ধি করবে, কোন জাদুবলে শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন। কোন যোগ্যতায় ‘বঙ্গবন্ধুই’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হবার গৌরব অর্জন করলেন।
তথ্য-উপাত্ত ঘেটে সহজেই বলা যায় বঙ্গবন্ধু ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ময়মনসিংহে এসেছিলেন। ১৯৪৯-এ ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলে উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু সে নির্বাচনের প্রচারকাজে যোগ দিতে যাবার সময় কারারুদ্ধ হন; তা নইলে হয়তো সেবারই হতো তাঁর ময়মনসিংহে প্রথম পদার্পণ। ১৯৫৪-এর নির্বাচনের সূচনা হয়েছিল ময়মনসিংহের মাটিতে, সেখানে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন; আমরা সবাই জানি। এভাবেই ময়মনসিংহের মাটি ও মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সখ্য। ১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। প্রধানত নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরের পর, ১৪ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরের প্রধান সড়ক রামবাবু রোডের ‘অলকা টকিজ’-এ আয়োজিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের জাতীয় কাউন্সিল। ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়বার প্রাথমিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল ময়মনসিংহ শহরে; যদিও যুক্তফ্রন্ট গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ময়মনসিংহতেই উপ্ত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের বীজ। দেশ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে প্রথম থেকে শেষাবধি শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্ট-ঐক্যফ্রন্ট করার বিপক্ষেই ছিলেন, প্রথমদিকে ঘোর বিপক্ষে ছিলেন মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমানও। সোহরাওয়ার্দী সাহেব উপরদল, ধীর-স্থির স্বভাবের মানুষ, তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন পরিস্থিতি। মূলত শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবকে নিয়েই ছিল প্রধান বিতর্ক। মওলানা ভাসানী ছিলেন শেরেবাংলাকে নেয়ার ঘোরবিরোধী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করলে আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিধাবিভক্তি আর নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা খুব সহজেই জানা যায়। সেখানেই জানা যায়, ‘ভাসানী সাহেব ও আমি পরামর্শ করলাম, কী করা যায়! তিনি আমাকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তবে তাঁকে গ্রহণ করা হবে এবং উপযুক্ত স্থান দেয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দল করেন তবে কিছুতেই তাঁর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করা চলবে না। যে লোকগুলো মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছে তাঁরা এখন হক সাহেবের কাঁধে ভর করতে চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে আমরা কিছুতেই মিলতে পারি না। মুসলিম লীগের সব কু-কর্মের সঙ্গে এরা ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জড়িত ছিল। এরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতার করেছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান : পৃষ্ঠা-২৪৪)। শেষপর্যন্ত কেনো ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজাপার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করে ১৯৫৪-এর নির্বাচন করেছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, তা আলোচনা বর্তমান রচনার লক্ষ্য নয়; বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেন; ‘গুরুত্ব দিতেন’ না বলে বরং বলা উচিত ‘মান্য করতেন’। সোহরাওয়ার্দী সাহেব, চাইছিলেন, হক সাহেব আওয়ামী লীগে যোগ দিন; হক সাহেবও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; কিন্তু তাঁরও একটা কলঙ্ক ছিল; তিনি বঙ্গভঙ্গ রোধের পক্ষে ছিলেন। ১৯৪৫-৪৬-এর নির্বাচনে তাঁর দলের ভরাডুবি হলে তিনি রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে যান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছু পর যখন নূরুল আমিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন তিনি শেরেবাংলা ফজলুল হককে পূর্ববাংলার এটর্নি জেনারেল পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ওই সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সঙ্গত কারণেই মুসলিম লীগের বিদ্রোহী পক্ষ যখন সরকারের বিরোধিতা করেছে, হক সাহেব তখন সরকারের পক্ষে ছিলেন; এমন কী বাংলার মানুষ যখন ভাষার জন্য লড়ছে, তিনি প্রায় মৌনব্রত পালন করেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পুনর্বার রাজনীতি করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন এবং তাঁর নিজস্ব দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করেন; আর দলের নামকরণ করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি শেরেবাংলার ভালোবাসার কথা সর্বজন বিদিত ছিল। সোহরাওয়ার্দী সে সময় বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘বৃদ্ধ নেতা, বহু কাজ করেছেন জীবনে, শেষ বয়সে তাঁকে একবার সুযোগ দেয়া উচিত দেশ সেবা করতে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান : পৃষ্ঠা-২৪৯)। মোটামুটি সিদ্ধান্ত হয়েই ছিল, দলে হক সাহেবকে মূল্যায়ন করা হবে, কিন্তু যখন হলোই না, যুক্তফ্রন্টের সম্ভাবনা তখন শূন্যের কোঠায়; তারপরও হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট কঠিন বিরোধিতার পরও কীভাবে যাত্রা শুরু করেছিল, কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেষপর্যন্ত সম্মতি দিয়েছিলেন, সব তথ্যই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে পাওয়া যাবে। আমি এখানে অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে রাজনীতির সেসব কূটকৌশল আলোচনা করতে চাই না; আমি বরং বঙ্গবন্ধুর ময়মনসিংহে আগমন বিষয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ উদ্ধার করতে চাই, বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমার একলার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছিল হাশিমউদ্দিনের বাড়িতে। আমি কেমন করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের রেখে হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে থাকি? পূর্বে যখন গিয়েছি, আমি হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতেই থাকতাম। খালেক নেওয়াজ, শামসুল হক, রশিদ ময়মনসিংহের বিশিষ্ট কর্মী, তারা হাশিমউদ্দিনকে পছন্দ না করলেও আমাকে ভালোবাসত। তাদের সাহায্যও পেলাম কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে। অলকা সিনেমা হলে সম্মেলন হবে। রাতে আমি খবর পেলাম, হাশিমউদ্দিন বাইরের লোক হলের মধ্যে পূর্বেই নিয়ে রাখবে অথবা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলার নামেও কিছু বাইরের লোক নিবে যাতে তারা সংখ্যাগুরু হতে পারে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান : পৃষ্ঠা-২৪৭-২৪৮)। বঙ্গবন্ধুর এ কথাগুলোতে যেমন বুঝতে পারি ময়মনসিংহে সে সময় কতটা নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ছিল, সহকর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌজন্য; পাশাপাশি এ কথাও স্পষ্ট হয় ১৯৫৩-এর মধ্য নভেম্বরের আগেও তিনি ময়মনসিংহে এসেছে এবং হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করেছেন; যার তথ্য-উপাত্ত আপাতত আমাদের হাতে নেই।
১৯৬৪-তে আইয়ুব খান তাঁর মৌলিক গণতন্ত্রের আলখাল্লায় পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী মোর্চার হয়ে আইয়ুব খানের বিপক্ষে প্রার্থী হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। ১৯৬৩-তে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারণায় সফরসঙ্গী হয়ে ময়মনসিংহে এসেছিলেন শেখ মুজিব। সার্কিট হাউসের বিশাল জনসভায় তিনি ভাষণও দিয়েছিলেন। সেদিন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে ময়মনসিংহের পথে এবং সার্কিট হাউস মাঠে জনতার ঢল নেমেছিল; নির্বাচনে আইয়ুব খান ফুলমার্কা নিয়ে ময়মনসিংহে পরাজিত হলেও শেষপর্যন্ত জিতেছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রের কৌশলে। সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘মনে আছে নির্বাচনে ময়মনসিংহে হারিকেন মার্কা জিতেছিল এবং সন্ধ্যায় আমরা বিজয় মিছিল বের করেছিলাম। রাস্তার পাশে তখন আইয়ুব খানের ফ্রেমে টাঙানো বড় বড় ছবি ছিল। টিনের পাতে আঁকা সেসব ছবি ভেঙে আমরা ড্রেনে পুঁতে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর বিজয়ানন্দে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে বুঝলাম মৌলিক গণতন্ত্রের জাদু। ময়মনসিংহে ফাতেমা জিন্নাহ জিতলেও সারাদেশের হিসাবে আইয়ুব খান জিতে গেছেন বিপুল ভোটে।’ (স্বপ্নকষ্টঘোর : ফরিদ আহমদ দুলাল : দৈনিক ভোরের কাগজ উপন্যাস সংখ্যা-২০১৮)।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের ৮২ জন আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যোগ দেন, তাদের একজন ছিলেন তৎকালীন তরুণ আইনজীবী আনিসুর রহমান খান; যিনি পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিব ময়মনসিংহে আসেন। সেবার তিনি আওয়ামী লীগের এক কর্মীসভায় ভাষণ দেন। আনিসুর রহমান খানের স্মৃতিচারণ থেকে আরো জানা যায় ১৯৬৬-তে যখন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তারপর ৬ দফা কর্মসূচির পক্ষে প্রচারণার জন্য ১৯৬৬-তেও শেখ মুজিব ময়মনসিংহে আসেন এবং সার্কিট হাউস মাঠে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। সেই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম; জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জননেতা রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াও সেই জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রীরা নানা অপপ্রচার শুরু করে। প্রচার করা হয় আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘বটমলেস বাসকেট’ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন; যদিও কিসিঞ্জার নিজে তা অস্বীকার করেছেন। সেই দুঃসময়েও বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহে সে সময়ের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র শিল্পীরা প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলার আয়োজন করে ঢাকা স্টেডিয়ামে; কেবল চলচ্চিত্র শিল্পী-কুশলীরাই নন, সে সময় দেশের বিভিন্ন স্তরের জনগণ দুর্গতদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু ‘চোরা না শোনে ধর্মের কথা’। ১৯৭৪-এ শেষবার যখন বঙ্গবন্ধু বন্যাদুর্গতদের দেখতে ময়মনসিংহে আসেন, সেদিন সার্কিট হাউস মাঠের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধুও লোকবাংলার সেই প্রবাদবাক্যটি উচ্চারণ করে ক্ষুব্ধ-ব্যথিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ, কম্বল আসল আট কোটি, তাহলে আমার ভাগের কম্বলটা গেল কই? আমি আমার দুঃখী মানুষের জন্য ভিক্ষা করে আনি, আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে!’ এত যে বন্যা-দুর্ভিক্ষ আর অপপ্রচার; কিন্তু তথ্য-উপাত্ত নিলে জানা যাবে, তেমন দুর্যোগেও বাংলাদেশে খুব বেশি মানুষ কিন্তু তখন খাদ্যাভাবে মারা যায়নি। ১৯৭৪-এ সেই বন্যাপীড়িত সময়ে বঙ্গবন্ধু শেষবারের মতো ময়মনসিংহে আসেন এবং বন্যাদুর্গত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। ১৯৭৪-এর জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু সিলেট ও ময়মনসিংহের বন্যাপরিস্থিতি পরিদর্শন করে বন্যাদুর্গত এলাকায় চারজন সিনিয়র অফিসার নিয়োগের নির্দেশ প্রদান করেন। (দৈনিক বাংলার বাণী ৩০ জুলাই ১৯৭৪)।
বারবার বঙ্গবন্ধুর ময়মনসিংহে আগমন, তা কি কেবল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন? মনে হয় না; বরং তাঁর মধ্যে যে সর্বমানবিকতার ঔদার্য, স্বাভাবিক যে সৌজন্যবোধ, তাঁর বুকে বাংলার মানুষের জন্য ভালোবাসার যে সমুদ্দুর নিত্য কল্লোলিত আর তরঙ্গিত; তা-ই তাঁকে টেনে এনেছে ময়মনসিংহের উর্বরা মাটির সুসংস্কৃত মানুষের কাছে। ময়মনসিংহের মাটি ও মানুষও তাই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদিন স্মরণ করে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন সর্বব্যাপী, বাংলার বৃক্ষরাজি যখন চৈত্রের শুরুতে পত্রপল্লবে সজিবতা পায়, তখন বাংলার মানুষ জেনে যায় শেখ মুজিবের জন্মদিন।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০