গণহত্যা-১৯৭১

মোনায়েম সরকার 

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের দিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সাথে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা সেদিনের ভাষণটি ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ড করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে বলা হয়েছিল ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো।’ এ ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ৮ মার্চ হাতবোমা, পেট্রোলবোমা ইত্যাদি তৈরি এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। গ্রেনেড তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, নটরডেম কলেজের আইরিশ অধ্যাপক চার্লস টাকার। বন্ধু হিসেবে সাথে ছিলেন অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্র, অধ্যাপক নূরুল আমিন ও ড. আবদুল্লাহ। বোমা বানানোর স্থান ছিল বুয়েটের আহসান উল্লাহ হল। বোমা কার্যকর কিনা তা পরীক্ষা করার স্থান ছিল চারুকলার পুকুর।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ১ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট স্থগিত করে দেন। সমগ্র দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। জনতা পথে নেমে আসে। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব স্তরের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলে। এমনি সময়ে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে ন্যাপের সভায় আমি উপস্থাপকের ভ‚মিকা পালন করতে গিয়ে বলি, এখন বক্তৃতা করবেন- ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।’ বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করায়, সে সময় আমি দল কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছিলাম। যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তানের সব জনগণ ‘বাংলাদেশ’ শব্দের সাথে প্রবলভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে এবং মনেপ্রাণে বাংলাদেশ শব্দটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।

সমগ্র দেশ উত্তপ্ত। পাকিস্তানি সৈন্যরা গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে এসে অবস্থান করছে। রাজপথে সৈন্যবাহিনীর টহল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কিছুতেই বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বাঙালিও পাকিস্তানি শাসন কিছুতেই মেনে নিবে না। শহরে গুজব রটে গেছে সামরিক বাহিনী শহরে বাঙালিদের ওপর হামলা চালাবে। সমগ্র শহরে বিভিন্ন স্থানে বাঙালি-ছাত্র-যুবক-শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য হামলার প্রতিরক্ষা ব্যূহ হিসেবে হাতিরপুলে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের সাথে প্রতিরোধ ব্যারিকেডে আমিও অংশগ্রহণ করি।

ঢাকায় জনরব শোনা যাচ্ছিল, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজপথে নেমে আসবে। সমগ্র শহর স্তব্ধ। শংকা সারা দেশবাসীর মনে। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে আছেন, কিন্তু তাঁর কি অবস্থা তা সরেজমিন পরখ করার জন্য সন্ধ্যার পরপর শোভা আপার ৩২ নম্বর সড়কের দ্বিতীয় বাড়ি থেকে বের হয়ে জনশূন্যহীন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকি। আবদুর রাজ্জাক এবং শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানের একটি লাল গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে চলে গেলেন কি রয়ে গেলেন এ সম্পর্কে উৎসুক এবং উদ্বিগ্ন আমি কিছুই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম না। অনেকটা হতাশ হয়ে ধানমন্ডি ২৪নং রোডে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাড়িতে গমন। সেখানে তাঁর পরামর্শে শ্যুটিং ক্লাবের কিছু অস্ত্র তাঁর বাসা থেকে মাজহারুল ইসলামের স্ত্রী বেবী আপার বড়ভাই কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গোপনে গাড়িতে করে পৌঁছে দিই স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এবং আমি- কারণ যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে এসব প্রয়োজন হবে বাঙালির। এমনই মানসিক প্রস্তুতি ছিল আমার। এই রাতেই শুরু হয়ে যায় বাঙালি নিধনের রক্তাক্ত অধ্যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ -বিজিবি) ব্যারাক আক্রমণের শিকার হয়। শুরু হয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির স্বাধিকারের লড়াই। স্বাধীনতার লড়াই।

২ দিনের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানিরা কারফিউ শিথিল করে শুক্রবার ২৭ মার্চ। এইদিন বন্ধু অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্রের মোটরসাইকেলে করে শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রদক্ষিণ করি। তাঁর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হত্যাযজ্ঞ পরিদর্শন ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে নির্মম। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চালায় তখন আমি তা সচক্ষে দেখেছি। সেই রাতে আমি উদ্ভ‚ত পরিস্থিতির কারণে সাইন্স ল্যাবরেটরি (এলিফ্যান্ট রোড) এলাকাতে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে বাধ্য ছিলাম। মধ্যরাতে গুলির আওয়াজ আর আগুনের আলোতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও তার আশপাশের বস্তিতে সেদিন কী তাণ্ডব চলছিল তা আমার বুঝে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।

২৫ মার্চ রাতে পুরো ঢাকা শহর এক মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছিল। বিনা কারণে একটি ঘুমন্ত জাতির ওপর পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ রকম পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছে কিনা তা আমার অজানা। বাংলাদেশের গণহত্যার পক্ষে প্রথম যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়ান- তার নাম পদগোর্নি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতবর্ষের ঋণ মনে রেখেও বলা যায়- তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিমান নেতা যখন পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বললেন- ‘ঝঃড়ঢ় এবহড়ংরফব’ তখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশের গণহত্যাকে সহানুভ‚তির দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শুরু করে। ‘জেনোসাইড’ বলতে যে ভয়ংকর নৃশংসতা বোঝায়, তা মোকাবিলায় বিশ্বসমাজের অবস্থান প্রকাশ পায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের কঠোরতায়। গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণ ও গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ২০১৫ সালে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে

SUMMARY

2591-১.jpg