জিয়াকে পদত্যাগ করতে বলেন বঙ্গবন্ধু : কে এম সফিউল্লাহ

ঝর্ণা মনি : 

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু জিয়াউর রহমান নানা কারণে কালক্ষেপণ করছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছিলেন। এর আগেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনা ঘটে। আর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হন বললেন কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ (কে এম সফিউল্লাহ) বীরউত্তম। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গতকাল বুধবার ভোরের কাগজের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে শোকের মাস আগস্ট, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জেনারেল জিয়াউর রহমানের তৎপরতা এবং সেনাপ্রধান হিসেবে তার নিজের অবস্থান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি।
জিয়া কেন আপনার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে জিয়া এবং আমি ছিলাম সবচেয়ে সিনিয়র। জিয়া আমার চেয়ে সিনিয়র ছিলেন। আর্মি ল’ অনুযায়ী, জিয়ারই সেনাপ্রধান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাকেই সেনাপ্রধান মনোনীত করেন এবং জিয়াকে ডেপুটি প্রধান করেন। উপপ্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানের বিশেষ কোনো ডিউটি ছিল না। সবসময় বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। আমি মনে করি, যে কারণে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়নি, সেই একই কারণে তাকে সেনাবাহিনীতে রাখাও ঠিক হয়নি। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার ও কর্নেল পদে হাতেগোনা দুই-তিনজন মাত্র বাঙালি ছিলেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে বন্দি অফিসার-সৈনিকরা ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দুই-তিন বছর জেল খেটে তারা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন। বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন মুক্তিযোদ্ধারা দুই বছরের সিনিয়রিটি পেয়েছেন। এতে তারা মানসিকভাবে নিজেদের ছোট ভাবতে থাকেন। দুয়েক বছর চাকরি করার পর যখন দেখল তাদের অবস্থান দৃঢ় তখন তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন কামনা করেন ও সুযোগ খুঁজতে থাকে। তারা একটা বড় সুযোগ পেয়ে যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় আপনার ভূমিকা নিয়ে এখনো কেউ কেউ বিতর্কের অবতারণা করেন এর জবাবে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, পঁচাত্তরে আমিও ষড়যন্ত্রের শিকার ছিলাম। আমার জুনিয়রদের অনেকেই জানত, কিন্তু আমাকে অন্ধকারে রেখেছিল। অনেক অফিসারই ছিল ষড়যন্ত্রের হোতা। তাই, আমি যখন জানলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অ্যাটাক হয়েছে, তখনই নির্দেশ দিয়েছি। শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তার কাছে যে তিনটি ব্যাটেলিয়ান আছে, তা নিয়ে প্রতিরোধ করতে। তিনি নির্দেশ অমান্য করেছেন। ওই সময় সালাউদ্দিন আর খালেদ মোশাররফ ছাড়া আমার কমান্ড তখন কেউ শোনেনি। আমি সবকিছুর বিহাইন্ডে ছিলাম। আমাকে অন্ধকারে রেখে তারা ষড়যন্ত্র করে, যখনই সফল হয়েছে, তখনই আমার নির্দেশ আমলে নেয়নি। পরে অনেকেই আমাকে ভুল বুঝেছিল। আমার লেখা ‘ফিফটিনথ আগস্ট আ ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি’ বইতে আমি এসব তুলে ধরেছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অ্যাটাক হয়েছে এটি আমি জানতে পারি ১৫ আগস্ট ফজরের নামাজের (প্রায় ৫.৩০) দিকে। আমার সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন সকালে এসে জানান, আর্মার ও আর্টিলারি ইউনিট বঙ্গভবন এবং রেডিও স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। এর আগে আর্মির কিছু সদস্য ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গেছে।
মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র মহড়া দেখেও সেনাপ্রধান হিসেবে আপনার সন্দেহ না হওয়ার কারণ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগস্ট ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল আর্মার ইউনিট আর আর্টিলারি ইউনিট। ওদের টহল আমাদের চোখে পড়েছে। কিন্তু আমরা ভেবেছি, ওদের নিয়মিত মহড়া হিসেবে হয়তো। কারণ ওদের ওপর নির্দেশ ছিল, মাসে নিয়মিত দুবার নাইট প্রশিক্ষণ করবে এবং সেটি হবে বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাত। ১৪ ও ১৫ আগস্ট ছিল বৃহস্পতি ও শুক্রবার। ফলে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্বেগ হয়নি। ট্যাংক আর আর্টিলারি যখন ক্যান্টেনমেন্টের মধ্য থেকে মুভ করে তখন সবাই ভেবেছে এটা তাদের নাইট প্রশিক্ষণের পার্ট। কিন্তু তারা যে ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছে এটা কেউ বুঝতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু তো আপনার কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন? আপনি কি সহযোগিতা করেছিলেন এর জবাবে তিনি বলেন, সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিয়ে আমি ঘরে ঢুকে প্রথমেই রেড টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করি। আমি তাকে ১২-১৪ বার ফোন করেও শুধু এনগেজড পাই। অন্য লাইনের মাধ্যমেও পাচ্ছিলাম না। তখন আমি আমার সেটটা আমার স্ত্রীর কাছে দিয়ে বললাম, তুমি বারবার চেষ্টা করতে থাক। লাইন পেলেই আমাকে দেবে। এর মধ্যেই আমি শাফায়াতকে ফোন করে সালাহউদ্দিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলি, তুমি তাড়াতাড়ি এটি প্রতিহত করার জন্য ব্যাটালিয়ান নিয়ে যাও। তিনটা ব্যাটালিয়নই পাঠাও। পরে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে টেলিফোন নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। এরপর রিসিভ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, সফিউল্লাহ, তোমার আর্মি আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। আমি তাকে বলেছি, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউজ।’ কারণ আমি এর আগেই শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর কোনো নির্দেশ দিলেন না। আমি হ্যালো হ্যালো করছি মনে হলো টেলিফোনটা সেটে না রেখে টেবিলে বা কোথাও ছিল আমি আওয়াজ পাচ্ছি। এর মিনিট খানেকের মধ্যেই আমি কিছু গুলির আওয়াজ পাই। আমার মনে হয়, সেটাই হয়তো বঙ্গবন্ধুর ওপর আক্রমণ ছিল। ৬টার আগেই হবে। কারণ আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি খুব সম্ভবত পৌনে ৬টা।
এরপর আমি আমার সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াকে ফোন করি। তারা দুজনই আমার বাসায় আসেন। জিয়া অফিসিয়াল পোশাকে অফিসের গাড়িতে আসেন। ক্লিন সেভ। আর খালেদ মোশাররফ আসেন স্লিপিং স্যুট পরে নিজেই ড্রাইভ করে। খালেদকে শাফায়াতকে সহায়তা করার নির্দেশ দেই। খালেদ মোশাররফকে বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলি। কিন্তু জিয়াউর রহমান পাঠাইও না, পাঠাইও না করে বলছিল, ‘হি ইজ গোয়িং টু বি স্পয়েলড।’ (স্পয়েলড মানে আমি বুঝতে পারিনি।)
তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে আমি রক্ষা করতে যেতে পারিনি। এই ব্যর্থতা নিয়েই আমি বেঁচে আছি। অনেকে বলেন, বিগ্রেডিয়ার জামিল বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে যেতে পারলে আমি কেন গেলাম না? আমি সেদিন যদি একা ৩২ নম্বরে যেতাম, তাহলে আমার পরিণতিও জামিলের মতো হতো।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০১৯ 

SUMMARY

2584-১.gif