মুহাম্মদ রুহুল আমিন :
তখনো ভোর হয়নি। কামান, বন্দুক, মর্টার, ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে নেমে পড়েছিল ঘাতকের দল। তাদের গোলাগুলিতে বাতাস ভরে উঠেছিল বারুদের গন্ধে। প্রধানত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে ঘিরেই ঘাতকদের তৎপরতা কেন্দ্রীভূত ছিল। গুলি হয়েছিল আরো কয়েকটি বাড়িতে। মর্টারের গোলা গিয়ে পড়েছিল দূরের কিছু এলাকাতেও। সেই বারুদের গন্ধে অসার হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ। হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ছিল না। এটি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক অপরাধের ঘটনা। এই ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশের উল্টোপথে যাত্রার সূচনা হয়েছিল।
গতকাল শুক্রবার পল্টনে সিপিবি কার্যালয়ে ভোরের কাগজকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ‘কলঙ্কিত ১৫ আগস্ট ও বঙ্গবন্ধু’ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। পঁচাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি ছিলেন সেলিম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তার নেতৃত্বে ডাকসু ও ঢাকার রাজপথে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন বঙ্গবন্ধু। তাকে বরণের জন্য নবরূপে সেজেছিল পুরো ক্যাম্পাস। তিনি আসবেন, ঘুরেফিরে দেখবেন তার এক সময়ের প্রিয় ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে চলা ধর্মঘটে সমর্থন দেয়ার তথাকথিত ‘অপরাধে’ যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একসময় বহিষ্কার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। প্রায় তিন দশক পর সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই, তার কোল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া সন্তান জাতির জনককে সসম্মানে বরণের জন্য প্রস্তুত ছিল। উৎসবের আমেজে সুসজ্জিত ও মুখরিত হয়েছিল সবগুলো ভবন, আঙিনা, প্রাঙ্গণ। কথা ছিল, ক্যাম্পাসে পদার্পণের পর বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের শহীদদের মাজার জিয়ারত ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন। এরপর মোটর শোভাযাত্রাযোগে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরবেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করবে। জগন্নাথ হলের বধ্যভ‚মিতে কিছুক্ষণ থাকবেন। ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলেন বিধায় শহীদুল্লাহ হল হয়ে সেই হলে যাবেন বঙ্গবন্ধু। শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছু সময় কাটাবেন। এরপর টিএসসি মিলনায়তন মঞ্চে ভাষণ দেবেন।
সেলিম বলেন, টিএসসি মিলনায়তনে হয়ত হাজার খানেক মানুষের জায়গা হবে। কিন্তু আরো হাজারো ছাত্র-জনতা যেন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে পারেন সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কলাভবন, মলচত্বর, নীলক্ষেত, শহীদ মিনার, চানখাঁরপুল, দোয়েল চত্বর এলাকাজুড়ে মাইক লাগানো হয়েছিল। পুরো এলাকা সুন্দর সুন্দর ব্যানার, হোর্ডিং, ফেস্টুনে সুশোভিত করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল সকাল থেকে মাইকে দেশাত্মবোধক গান, কবিতা, যন্ত্রসঙ্গীত প্রচার করা হবে। উদ্দীপনামূলক ও আনন্দঘন আবহে সমস্ত ক্যাম্পাসকে ভরিয়ে তোলা হবে। সবার অধীর অপেক্ষা, কখন সূর্যোদয় হবে, কখন বঙ্গবন্ধু এসে আলোকিত করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিন্তু না; তিনি এলেন না। তাকে আসতে দেয়া হলো না। সূর্যোদয়ের আগেই ঘাতকরা ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা দুর্বল ছিল না। তাদের সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক মদদ। আঘাত হানতে তারা কৌশলী দক্ষতায় অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। সরকারের নানা ব্যর্থতা, গুরুতর ভ্রান্তি ও ত্রু টি-বিচ্যুতির সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে চরম উদাসিনতা, ‘কোনো বাঙালি আমার গায়ে হাত তুলবে না, হাত তুলতে গেলে তার হাতই কেঁপে যাবে’ মর্মে অন্ধ আত্মবিশ্বাস, শত্রু যে কত ভয়ঙ্কর বর্বর হতে পারে সে সম্পর্কে উপলব্ধির দুর্বলতাকে তারা ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিল। ঘরের মধ্যেই ছিল শত্রু র চর। উপযুক্ত সময় বাছাই করে তারা দক্ষতার সঙ্গে চরম আঘাত হেনেছিল।
হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে বঙ্গবন্ধু দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সূচনা করেছিলেন উল্লেখ করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে একক একটি ‘জাতীয় রাজনৈতিক দল’ প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী করা হয়েছিল। এর কিছুদিনের মধ্যেই গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণায় গড়ে ওঠা এবং সেই দাবিতে দীর্ঘ যুগ ধরে সংগ্রাম করে আসা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। বাকশালের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সম্পর্কে মানুষকে বুঝিয়ে তোলা ও সচেতন করার কাজ শুরুই করা হয়নি। নবগঠিত বাকশালের কমিটি গঠনের কাজ শুরু হলেও সেগুলো তখনো সর্বত্র ঘোষিত হয়নি। যেগুলো ঘোষিত হয়েছিল সেগুলোও সেভাবে কাজ শুরু করেনি। এরকম একটি শূন্যতার সুযোগ নিয়ে শত্রুরা তাদের আঘাত হানার দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করেছিল।
জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ভ‚মিকা রেখেছে মন্তব্য করে সিপিবি সভাপতি বলেন, বিভিন্ন কারণে বঙ্গবন্ধুর সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আওয়ামী বিদ্বেষী উগ্র জাসদ প্রভাবশালী হয়ে উঠে। বাকশাল গঠনেই শুধু নয়, আগে থেকেই জাসদ ছিল অন্ধভাবে আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে। সরকার উৎখাতে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের মতো হঠকারী-জঙ্গি কর্মসূচিও নিয়েছিল। গণবাহিনীসহ নানা গোপন তৎপরতায় তাদের অনেকেই লিপ্ত ছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একদিকে চলছিল নানা দ্ব›দ্ব-বিরোধ, অন্যদিকে বিরাজ করছিল আদর্শগত বিভ্রান্তি। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, জোট নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র অভিমুখিতা নীতির বৈরী একটি শক্তি আওয়ামী লীগের ভেতরে ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল অংশের নেতা খুনি মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে স্থান করে নিয়েছিলেন। এই মোশতাকই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘কনফেডারেশন’ গঠনের জন্য তৎপর হয়েছিলেন। অথচ ’৭৩ সালের নির্বাচনে মোশতাককে দাউদকান্দি আসন থেকে জিতিয়ে আনার জন্য ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রেখে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে ‘চ‚ড়ান্ত’ ফলাফলের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তাকে বাকশালের প্রেসিডিয়ামে স্থান দেয়া হয়েছিল। অথচ তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে মোশতাকের ষড়যন্ত্রমূলক চরিত্র সম্পর্কে জানতেন না, তা নয়। কিন্তু, শত্রু যে কত ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর হতে পারে তার হিসাব কষতে বঙ্গবন্ধুর ভ্রান্তি ঘটেছিল। এটাই হয়ে উঠে তার জন্য প্রাণঘাতী।
তিনি বলেন, খুনিরা প্রচারণা চালিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণে নিজেকে ‘আজীবন রাষ্ট্রপতি’ ঘোষণা করে দেশে ‘রাজতন্ত্র’ প্রবর্তন করবেন। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে ঘাতকদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। রাষ্ট্রের কিছু স্পর্শকাতর স্থানে তারা অনুপ্রবেশ করে অন্তর্ঘাতের আয়োজন করেছিল।
ক্যাম্পাসেও প্রত্যক্ষ তৎপরতা শুরু করেছিল খুনিচক্র। ১৩ আগস্ট পাকিস্তানের পক্ষে একটি লিফলেট বিতরণ করা হয়েছিল ক্যাম্পাসে। ১৪ আগস্ট সকালে শামসুননাহার হলের গেটের দেয়ালে পাকিস্তানের পতাকা দেখা গিয়েছিল। ওইদিন বেলা ১১/১২টায় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে, অ্যানেক্স ভবনের দোতলার বাথরুমসহ কয়েকটি জায়গায় শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছিল। ডাকসুর ভিপি হিসেবে ক্যাম্পাসের যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে জানার একটা বড় দায়িত্ব আমার ছিল। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আমি দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের পতাকাটি আমরা তৎক্ষণাৎ নামিয়ে ফেলি। স্প্লিন্টারগুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, গ্রেনেডগুলো ছিল সামরিক কাজে ব্যবহার যোগ্য। পরে জাসদ দাবি করে, ‘নিখিল বোমা’ বলে পরিচিত তাদের ক্যাডার নিখিলের হাতে প্রস্তুত ছিল এসব গ্রেনেড। নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তিত হই। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে দ্রুত খবর দেই। তারা সতর্কতামূলক তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন এলাকায় মেটাল ডিটেক্টর ও মাইন ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করে। সন্ধ্যার পর সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাপ্রধান ক্যাম্পাসে এলে টিএসসিতে তার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি সবধনের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন।
সেলিম বলেন, পরে অনেক ভেবেছি ক্যাম্পাসে এসব ঘটনা কি ‘ডাইভার্সনারি’ কৌশল হিসেবে সংগঠিত করা হয়েছিল? ভোর হওয়ার আগেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যখন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তখন নিরাপত্তা সংস্থার দায়িত্বশীলরা ক্যাম্পাসে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার আয়োজন করতে ব্যস্ত! কি অদ্ভুত ও রহস্যজনক!
ওইরাতে ছাত্র সমাজের কর্মীরাও নিজস্ব নিরাপত্তা তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। স্বেচ্ছাসেবকরা নজরদারি ও পাহারার দায়িত্বে ছিল। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমিও ক্যাম্পাসে টহল দিয়েছি। শেখ কামালও স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। রাত দেড়টা দুটার দিকে তিনি সকাল সকাল আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি চান। সদ্য বিয়ে হয়েছে এই চিন্তা করে তাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মোটরবহরের সঙ্গে নয়, আলাদাভাবে সকাল ৮টার মধ্যে সে ক্যাম্পাসে আসবে এই শর্তে তাকে বাড়ি যেতে বলেছিলাম। আজো আমার একটি বড় কষ্ট এ কথা ভেবে যে, শেখ কামালের জীবন হয়ত রক্ষা পেত যদি আমি সেদিন আরেকটু ‘অমানবিক’ হয়ে তাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে আমাদের সঙ্গে রেখে দিতাম!
ভোরে বহুদূরে কামান, মর্টার ও গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। মোটরসাইকেলে দুজনকে সেই আওয়াজের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিতে পাঠাই। তারা জানাল, ধানমন্ডির দিকে গোলাগুলি হচ্ছে। আওয়াজের কাছাকাছি কেউ যেতে পারছে না। বিস্তারিত জানতে আরেকটি দল পাঠাই। ইতোমধ্যে রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার মর্মান্তিক খবরটি জানতে পারি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্তম্ভিত হই। কলাভবনে দাঁড়িয়েই তাৎক্ষণিকভাবে কর্তব্য স্থির করি। কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে হাতিরপুলের একটি বাসায় উঠে টেলিফোনে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। নির্দেশ পাওয়া মাত্র প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত থাকতে বলি। চারদিকের খবরা-খবরও নিই। খবর আসে ঘাতকরা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হচ্ছে। দুপুরের আগেই তিনবাহিনীর প্রধান, বিডিআর, পুলিশ প্রধানরা একে একে খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৪/৫ জন ছাড়া বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবাই খুনি মোশতাকের অধীনে শপথ নেন। রেডিওতে ঘোষণা ও নির্দেশমালা প্রচার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। সারা দেশে জারি হয় কারফিউ। দুপুরের মধ্যেই স্পষ্ট হয়, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পাশাপাশি এক প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে সফল হয়েছে। এ অবস্থায় তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়া যে সম্ভব না তা আমরা অনুধাবন করি। তাই কিছুটা সময় এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিরোধ শুরুর সিদ্ধান্ত নিই। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা মাত্রই ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। ওইসময় অল্প কয়েকজন ছাড়া ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে উধাও হলেও ছাত্র ইউনিয়নের কিছু নেতাকর্মীর যাতায়াত ছিল। ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিনই ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’ স্লোগানে কলাভবনে ঝটিকা মিছিল হয়। পরদিন ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাই। ৪ নভেম্বর ৩২ নম্বর অভিমুখে মৌন শোক-মিছিলের কর্মসূচি দেই। এটি লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করা হয়। লিফলেট বিতরণ করার সময় ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা মিছিল বের করে স্লোগান দেয়, ‘রুশ-ভারতের দালালরা-হুঁশিয়ার’, ‘সেলিমের কল্লা চাই’। এতে আমরা দমিনি। ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আমরা হাজারো শিক্ষার্থীরা জমায়েত হই। সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীও ছিলেন। আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে আমি আবেগময় বক্তৃতা করি। পরে ৩২ নম্বর অভিমুখে মৌন মিছিল শুরু হয়। নীলক্ষেত ফাঁড়ির সামনে পুলিশ বাধা দিলে তাদের সঙ্গে আমার তপ্তবাক্য বিনিময় হয় এবং তাদের ব্যারিকেড ভেঙে আমি মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাই। ৩২ নম্বর বাড়ির বন্ধ গেটের সামনে সবার পক্ষ থেকে আমি পুষ্পমাল্য অর্পণ করি। রাজধানীর রাজপথে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। যখন প্রতিবাদ করছিলাম, ঠিক তখনই জানতে পারি ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। ফেরার সময় মিছিল থামিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের খবর ছাত্র-জনতাকে দেই। প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর অর্ধ দিবস হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করি। পরদিন হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে গায়েবি জানাজা হয়। ‘খুনিরা’ দেশ ত্যাগ করে। পরপর কয়েকদিন চলতে থাকে বিভ্রান্তিকর, অস্থিতিশীল-অনিশ্চিত অবস্থা। এরমধ্যেই ৭ নভেম্বরের ঘটনার মাধ্যমে সূচনা হয় নতুন এক পর্বের। শুরু হলো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া বারুদের গন্ধ মুছে ফেলার প্রক্রিয়া। সেই কাজ এখনো শেষ হয়নি! দীর্ঘ বছর পর হলেও ঘাতকদের বিচার হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে কয়েকজনের। কিন্তু এই ঘটনার পেছনে থাকা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এখনো সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়নি। দেশকে আজো মুক্তিযুদ্ধের সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদের ধারায় ফিরিয়ে আনা যায়নি। এ কাজ সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত বাতাসে বারুদের সেই গন্ধ সম্পূর্ণ দূর হবে না।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : আগস্ট ১০, ২০১৯