ড. এম এ মাননান, উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা চলছে। সরকার ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত এ বর্ষ উদযাপন করা হবে। জন্মশতবার্ষিকী একটি দিনে নয়, সারা বছর ধরে প্রতিদিন, যা পরিচিতি পাবে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে। মুজিববর্ষ নাম হয়েছে তাঁরই নামানুসারে যাঁর নামটি ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলার ইতিহাসে, ইতিহাসের পাতায় প্রোথিত হওয়া যে নাম ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’-এর গায়ে খোদিত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সুনীল আকাশে- তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সবার প্রিয় ‘শেখ মুজিব’।
কেন মুজিববর্ষ ২০২০? কী থাকবে এ বর্ষে? জানার কৌতূহল হয়তো আছে অনেকেরই। কিছু দিন আগে গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় দেখেছি, অনেকেই জানেন না মুজিববর্ষ কি এবং কেন পালন করা হবে এটি। প্রায় সবাই জানতে চেয়েছেন এর বিস্তারিত বিষয়। তখনই মনে হলো মুজিববর্ষ সম্পর্কে কিছু লিখি। স্বল্প পরিসরে অনেক কিছুই লেখা সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে মোগল আমলে গড়া স্মৃতিময় দালানকোঠারই পাশে সম্ভ্রান্ত বাপ-দাদার টিনের ঘরে জন্ম নেয়া ‘রাখাল বালক’ অকুতোভয় শেখ মুজিব অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে জীবনের মূল্যবান সময় জেলহাজতে থেকে, পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতা থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটিয়ে শত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও শুধু একটি চাওয়া নিয়ে জীবনভর যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। আর সে চাওয়া ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার জন্য একটি আলাদা পতাকা, একটি স্বাধীনসত্তা আর সব বাঙালির জন্য একটি সম্মানজনক জীবন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকেই তিনি এ ভাবনা হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছিলেন; তখনই তাঁর মনে হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি দেশ থাকতেই হবে শুধু বাঙালিদের জন্য, বাংলা নামটা মুছতে দেয়া যাবে না কোনোমতেই। সৃষ্টি করলেন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন। ধীরে ধীরে বুনন করে দিলেন এ স্বপ্ন সব বাঙালির হৃদয়ে। এ স্বপ্নের মধ্যেই প্রোথিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের শিকড়। সময়ের বিবর্তনে একদিন রাখাল বালক থেকে হয়ে উঠলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি সব বাঙালিকে এক কাতারে নিয়ে আসলেন, ঐক্যের পতাকার নিচে দাঁড় করালেন, এক সুরে একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির জন্য সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলেন এবং একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করলেন। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের অতর্কিত অমানবিক বর্বরোচিত আক্রমণের মুখে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছড়িয়ে দিলেন ইথারের মাধ্যমে মধ্যরাতের একটু পরেই, বন্দি হওয়ার আগমুহূর্তে : ‘…আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন…’। হলেন তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। সারা জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম মুক্তিযুদ্ধে। সবার জানা আছে, ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীনতা। শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন তখনকার অতিপরিচিত ‘মুজিব ভাই’; হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পিতা। আর এ মহান পুরুষকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, তাঁর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করা, প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তাঁর নীতি-আদর্শ সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া বর্তমান প্রজন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যেই আমরা উদযাপন করব মুজিববর্ষ। এ বছরের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত পুরো এক বছর হবে মুজিববর্ষ। আর মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হয় ১০ জানুয়ারি বিকাল ৫টা থেকে। এ দিনটিকে ক্ষণগণনার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে পাকিস্তানি জল্লাদদের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন শুরু হবে আগামী ২০২০ সালের ১৭ মার্চ। মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা কেন হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর ভাষায় : ‘১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অসাধারণ সময়। সেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন। সারাদেশ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর ও রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ক্ষণগণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে জাতির জনককে নিয়ে বিমানটি অবতরণ করেছিল। সেদিন সেখানে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করা হয়েছিল। …ক্ষণগণনা অনুষ্ঠানে আমরা একটি প্রতীকী আবহ তৈরি করতে চাই।’ তিপান্নটি জেলাসহ টুঙ্গিপাড়া এবং মুজিবনগরে ক্ষণগণনার যন্ত্রের মাধ্যমে সারাদেশে ক্ষণগণনা শুরু হবে; অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রসঙ্গক্রমে জেনে রাখা ভালো, মুজিববর্ষ ইউনেস্কোর সদস্য-তালিকাভুক্ত ১৯৫টি দেশে একযোগে পালিত হবে। ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ পরিষদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে মুজিববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্বীকৃতি আবারো প্রমাণিত হলো এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর অবদান ও বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো।
মুজিববর্ষে সারাদেশের শহরে, গ্রামেগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হবে স্বাধীনতার সত্য-ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং দর্শন, আদর্শ, চিন্তা-চেতনা যা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়কালে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ- এ কথাটি তরুণ প্রজন্মের মনে গেঁথে দিতে হবে; তাদের জানাতে হবে বঙ্গবন্ধু কেন একটি স্বাধীন দেশ চেয়েছিলেন, কেন তিনি জীবনের সব সুখভোগ বিসর্জন দিয়ে শুধু একটি পতাকার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, কেন তিনি জল্লাদদের কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে আপস করেননি, কেন তিনি সব বাঙালির জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পথে পা বাড়িয়েছিলেন এবং সব প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন। তরুণরা জানতে চায় সঠিক ইতিহাস, সঠিক তথ্য। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনো সক্রিয়; তারা চুপ করে বসে নেই। তারা সুযোগ পেলেই অতীতের মতো ইতিহাস বিকৃত করবে। মৃত বঙ্গবন্ধুকে এখনো তারা ভীষণ ভয় পায়। তারা সদাসর্বদা চেষ্টা করবে বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকে ম্লান করতে; অথচ বঙ্গবন্ধুর কীর্তিই বাঙালি জাতিকে সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে এবং তাঁর কীর্তিই আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছে, বুক ফুলিয়ে কথা বলার অধিকার দিয়েছে, শির উঁচু করে চলার সুযোগ করে দিয়েছে। তাঁর কীর্তি আর মহত্ত্ব প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে, তরুণ মনে সাহস জোগাবে, তাঁরই প্রতিষ্ঠিত দেশকে উন্নয়নের ছোঁয়ায় বিশ্বপরিমণ্ডলে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করবে।
আমাদের প্রত্যাশা, মুজিববর্ষে দেশ থেকে সব অনাচার দূর হবে, একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, গ্রাম আর শহরের বৈষম্য হ্রাস পাবে, গুটিকতক লোকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হবে না, নদীগুলোর কান্না বন্ধ হবে, পাহাড়গুলোর গায়ে কেউ কোপ মারবে না, কেউ জলাশয় আর খালনালা দখল করবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কোনো প্রতিষ্ঠানে/কর্মস্থলে লাম্পট্য থাকবে না, শহরগুলো সব প্রকার দূষণমুক্ত হবে, সড়কে মানুষ পিষ্ট হবে না, ইতিহাস বিকৃতির রাস্তা বন্ধ হবে এবং সমাজে সুন্দরভাবে বসবাসের একটি কল্যাণকর আবহ তৈরি হবে।
ড. এম এ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২০