সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে জনমনে শক্তি সঞ্চারিত হয়

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে জনমনে শক্তি সঞ্চারিত হয়

 সৈয়দ আবুল মকসুদ 
এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই কথাটি শোনার পর উপস্থিত মানুষের মধ্যে শক্তির সঞ্চার হয়। কারণ এটাই তারা শুনতে চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু আর কী কর্মসূচি দেন, সেটার জন্যও তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। আর প্রতিপক্ষের হামলা মোকাবিলা করতে নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতি নেয়ার একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তাদের মধ্যে দেখা গেছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ চলাকালীন উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভোরের কাগজের কাছে সেদিনের স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মানুষের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, এমন প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেক মানুষই সেদিন রেসকোর্স ময়দানে আসতে পারেননি। কারণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে প্রচার করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। রেডিওতে ভাষণ প্রচার করা হবে না- এই ঘোষণা যদি আগে থেকেই দেয়া হতো, তাহলে ঢাকা শহরে লোক ধারণের জায়গা থাকত না। ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু যখন বলেন ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই কথাটিই মানুষ শুনতে চেয়েছিল। এটা শোনার পর তাদের মধ্যে একটা শক্তির সঞ্চার হয়। ভবিষ্যতে তিনি আর কী কর্মসূচি দেন, সেটার জন্য মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে।

এক থেকে ৭ মার্চের স্মৃতিচারণ করে আবুল মকসুদ বলেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে তার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রতিদিনই বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। ১ তারিখ আমি পূর্বাণী হোটেলে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন, আগামীকাল (২ মার্চ) ঢাকায় পূর্ণ দিবস হরতাল। ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল। ৭ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেব। সেখানে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব। ওইদিন থেকেই মানুষ স্বাধীনতার জন্য রাস্তায় অব্যাহতভাবে স্লোগান দিতে থাকে তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা। ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িতে আমরা তরুণরা দল বেঁধে যেতাম। সারাদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও আসত বঙ্গবন্ধুর প্রতি সংহতি জানাতে- যে বঙ্গবন্ধু কী বলেন। মানুষের মধ্যে প্রস্তুতি ছিল বঙ্গবন্ধু একটা চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। সেই সিদ্ধান্ত স্বাধীনতা-সংগ্রামের সিদ্ধান্ত। ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ ৬ মার্চ ঢাকায় এসে পৌঁছায়। পরদিন সকালে মানুষ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশস্থলে আসা শুরু করেন। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ঢাকা ক্লাবের গেটের সামনে। ১০টার মধ্যেই রেসকোর্স ময়দান লোকে ভরে গেছে। বেলা ১২টার মধ্যে শুধু রেসকোর্স ময়দানই নয়- হাইকোর্ট, প্রধান বিচারপতির বাসা, এলিফেন্ট রোড, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ সমস্ত জায়গা লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেল। সুশৃঙ্খলভাবে মানুষগুলো চুপ করে বসে আছে।

বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন, তখন পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে তারা সেই ভাষণ শোনেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণকে যেভাবে সম্বোধন করলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’- তাতে মনে হয়েছে যে প্রত্যেকটা লোকের সঙ্গে মনে হয় বঙ্গবন্ধু কথা বলছেন। মানুষের মনটাকে তিনি প্রস্তুত করেছেন। বললেন- তোমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আরো বড় সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন। সেটা যদি তারা না দিয়ে আমাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করে, তাহলে তোমাদের প্রস্তুত হতে হবে। এভাবে প্রস্তুতির কাজটা তিনি ওই মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে করেছেন।

এই গবেষক বলেন, ২৫ মার্চ এরকম একটা গণহত্যা শুরু হবে এই ধারণাটা কারো মধ্যেই ছিল না। হাজার হাজার মানুষ সেই রাতে মারা গেছেন। সেটা ধারণা ছাড়াই একটা লড়াই যে পাকিস্তানিদের সঙ্গে করতে হবে, তার প্রস্তুতিটা সমাবেশ থেকেই বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন। মানুষ এই বক্তব্যকে এমনভাবে বুকে ধারণ করেছেন, যে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে তারা প্রস্তুত হয়েছিলেন। তাদের ধারণা-পাকিস্তানিরা আধুনিক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করবে, আর তারা তাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রতিরোধ করবে। এই প্রতিরোধের প্রস্তুতির কাজটি ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেই আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল। এটি মানুষ গ্রহণ করেছিল বলেই এই ভাষণটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কালজয়ী ভাষণ হয়ে রয়েছে। যে ভাষণটি একটা জাতির ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দেয়। সেটি হলো এই ভাষণের তাৎপর্য।

আপনার দৃষ্টিতে এই ভাষণের চুম্বক অংশ কোনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষ বাক্য যেটা সেটাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এর ভেতরে ‘আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’ অর্থাৎ যত অত্যচারই করো না কেন, আমরা পরাজিত হওয়ার মানুষ না। এই কথাটা আমার কাছে চুম্বক মনে হয়েছে। আরেকটা কথা হলো ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই’।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ৭, ২০২০ 

SUMMARY

2556-১.jpg