ভাসানীকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু

কাগমারী সম্মেলন ও টাঙ্গাইলে আগমন:ভাসানীকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু

মো. জহিরুল ইসলাম, মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) 


আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে দল থেকে পদত্যাগ না করতে বারবার অনুরোধ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার পদত্যাগপত্র তিনি গ্রহণ করবেন না বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনো অনুরোধ কাজে আসেনি। বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে অলি আহাদের মাধ্যমে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন ‘ভাসানী ফাউন্ডেশনে’র সভাপতি খন্দকার নাজিম উদ্দিন।

এ বিষয়ে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতা চেষ্টা করেছিলেন যাতে এ ভাঙন না ঘটে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কৌশলে পদত্যাগপত্র পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে না পাঠাইয়া মওলানা সাহেবের অনুগত মি. অলি আহাদের মাধ্যমে বামপন্থি খবরের কাগজে পৌঁছিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু অনেকবার অনুরোধ করেছেন যাতে মওলানা সাহেব পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন।

ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে টাঙ্গাইল এসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে খন্দকার নাজিম উদ্দিন বলেন, ১৯৫৭ সালের ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। তিনদিনব্যাপী এ কাউন্সিল উপলক্ষে টাঙ্গাইল পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে কাগমারী (সন্তোষ) পর্যন্ত লেলিন তোরণ, গান্ধী তোরণ, নেতাজী সুভাস বসু তোরণ ইত্যাদি নামে প্রায় ১০০ তোরণ নির্মাণ করা হয়। এ সম্মেলনে সাংস্কৃতিক পর্বের জন্য পূর্ব বাংলা ও ভারতের প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকের আগমন ঘটেছিল। রাধা রানী দেবী, তারা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, পি এম সৈয়দ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রমুখ বুদ্ধিজীবী ও কবি সাহিত্যিকরা এসেছিলেন। এ সম্মেলনে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি; প্রধানত এই দুটি ইস্যুতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হয়। এ দুটি বিষয়ে একমত না হতে পেরে মওলানা সাহেব আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।

প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এই ভাঙনের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আবুল মনসুর আহমদের মতে, এটা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা সাহেবের মধ্যে বিরোধ বাধাইবার একটা কৌশল। আওয়ামী লীগে ভাঙন আনাই তার উদ্দেশ্য।

খন্দকার নাজিম উদ্দিন আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু কাগমারী সম্মেলনের পর ১৯৬৭, ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইল এসেছিলেন। অনেক টাঙ্গাইলবাসীর তাকে কাছ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

যাহোক, বঙ্গবন্ধুসহ তৎসময়ের আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তখন কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে রাত্রিযাপন করতেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে যারা দেখেছেন তাদের অনেকেই এখনো জীবিত আছেন। তাদের মধ্যে মির্জাপুর গ্রামের অতুল পোদ্দার (৮৬) বলেন, আমার জীবন ধন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে অতি কাছ থেকে দেখেছিলাম। তার সঙ্গে আমি কথা বলতে পেরেছিলাম। তিনি যে মহান এক নেতা তা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি প্রতিদিনের ন্যায় ভোরে ফুল তুলতে কুমুদিনী পুকুর পাড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখি পুকুরের পাড় দিয়ে সাদা চেকের লুঙ্গি পড়া, সাদা পাঞ্জাবি ও চাদর গায়ে একজন লম্বা লোক হাঁটছেন। আমি তখন কিশোর। সাহস করে তার কাছে গেলাম। বললাম, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি দাঁড়ালেন, বললেন, গোপালগঞ্জ। আপনার নাম কী? বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে বললেন- শেখ মুজিবুর রহমান, এ বলে আমার কাঁধ হাত রেখে আবারো মৃদু হেসে চলে গেলেন। পরে জানতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতা তখন কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে কুমুদিনী হাসপাতাল কমপ্লেক্সের রয়েল গেস্ট হাউসে (জিরো কোয়ার্টার) এসেছেন। সেই সময়কার কথা বলতে গিয়ে অতুল পোদ্দার অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন। তিনি আরো বলেন, যেদিন জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে সেদিন থেকে আমার বুকের মধ্যে খুব চাপা কষ্ট অনুভব করি। তাই আমি আজো আগস্ট মাস এলেই বঙ্গবন্ধু স্মরণে পুরো মাস কালোব্যাচ ধারণ করি। মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের ওই সময়ের বিদ্যুৎ মিস্ত্রি মির্জাপুর গ্রামের অর্জুন চন্দ্র সাহা (৮২) বলেন, বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যের সুখটুকু নিয়ে আজো বেঁচে আছি।

বঙ্গবন্ধুর প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবার টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মির্জাপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে এক পথসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিচ্ছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য হাজারো জনতা জমায়েত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন রাস্তার পাশে শত শত জনতার চাপে ‘সিএন্ডবি’র দুচালা ঘরের চালটি ভেঙে পড়লে বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু মাইকেই বলেন, ওই জ্ঞানা (কুমুদিনী হাসপাতালের তৎসময়ের ওয়ার্ডবয় প্রধান জ্ঞানেন্দ্র কুমার সাহা) আমাদের নেতাকর্মীদের সাহায্যে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দাও। সবাই তখন অবাক, বঙ্গবন্ধুর জ্ঞানার নাম কীভাবে এখনো মনে রেখেছেন? তিনি তো সেই ১৯৫৭ সালে কুমুদিনীতে ছিলেন। সেখানে জ্ঞানেন্দ্র কুমার সাহা (জ্ঞানা) বঙ্গবন্ধুকে কয়েকবার চা এগিয়ে দিয়েছেন মাত্র। এত বছর পর রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি একজন ওয়ার্ডবয়ের নাম মনে রেখেছেন। একজন মহান মানুষের পক্ষেই এ সম্ভব।

মো. জহিরুল ইসলাম, মির্জাপুর, ১২-০৩-২০২০।
খন্দকার নাজিম উদ্দিন ভাসানী ফাউন্ডেশনের সভাপতি ফোন নম্বরঃ ০১৮১৯৪৬৫০২৯।

সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২০ 

SUMMARY

2553-১.jpg

অতুল পোদ্দার