বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল বেতবুনিয়াতে

ভোরের কাগজকে রানা দাশগুপ্ত: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল বেতবুনিয়াতে

সমরেশ বৈদ্য, চট্টগ্রাম 


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে টাইমবোমা দিয়ে মেরে ফেলার সব চক্রান্ত করা হয়েছিল। সেটি হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন, চট্টগ্রামেই। অর্থাৎ চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি সীমান্তবর্তী বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের প্রেসিডেন্ট এবং বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। সে সময়েই যে মঞ্চের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে উদ্বোধনের কথা ছিল তার নিচেই পুুঁতে রাখা হয়েছিল টাইমবোমাটি। তবে সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া পৌঁছানোর আগেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেটিকে শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে সে যাত্রায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, তার মাত্র ২ মাসের মাথাতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে অকুতোভয় অবিসংবাদিত নেতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো।’

পিলে চমকানো এমন তথ্যগুলো ভোরের কাগজের কাছে প্রকাশ করলেন সে সময়কার তরুণ রিপোর্টার রানা দাশগুপ্ত। তখন তিনি ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ নামে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় কাজ করতেন। বর্তমানে বয়সে প্রবীণ রানা দাশগুপ্ত বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক ও মানবাধিকারবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর।

তিনি আরো বলেন, ‘সেদিন যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও সব আয়োজন হয়েছিল তা কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করা হয়নি।’ কেন প্রকাশ করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি অনেকটা দৃঢ়তা ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট বা পিআইডি থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল।’ সেদিনের সেই তরুণ সাংবাদিক ও বর্তমানে নানা গণতান্ত্রিক-মানবাধিকার আন্দোলনের এই যোদ্ধা সেই হত্যা ষড়যন্ত্রের খবরটি প্রকাশ না হওয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দুই আসামির দিকে তার সন্দেহের তীর ছুড়ে দিলেন।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘এরা হলেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পেছনে যে ষড়যন্ত্রকারীরা ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন এই দুই মন্ত্রী। দুজনই কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। কিন্তু কোন রহস্যজনক কারণে তারা সেই মামলা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন জানি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ বিষয়টি সঠিক অনুসন্ধানের দাবি ও অনুরোধ করছি।’

এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য, ‘এই স্বাধীন বাংলাদেশে তারই কিছু কাছের লোক (যারা ছিল মুখোশধারী-বর্ণচোরা) এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।’ সেদিনের এই হত্যা-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তো ছিলাম বঙ্গবন্ধুর গাড়ির বহরের সঙ্গে। বেতবুনিয়া থেকে মাইল দেড়েক আগেই গাড়ির বহরটিতে হঠাৎ আটকিয়ে দেয়া হলো। পরে

জানতে পেরেছি ওই বহরে থাকা বঙ্গবন্ধুর গাড়িকে অন্য একটি বিকল্প রাস্তা দিয়ে বেতবুনিয়ার ভ‚-উপগ্রহ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার নিরাপত্তার জন্য। আর এদিকে আমাদের বাকি গাড়িগুলোকে যাওয়ার অনুমতি দিলে আমরা ভ‚-উপগ্রহ কেন্দ্রের ভেতরে সাংবাদিকদের জন্য বসার নির্ধারিত স্থানে গেলাম। তখন দেখলাম সারা মাঠে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মেটাল ডিটেকটর দিয়ে তল্লাশি করছেন। আরো জানতে পারলাম এর ঘণ্টাখানেক আগে যে মঞ্চের পাটাতনে ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বোতাম টিপে এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করতেন তার নিচ থেকেই টাইমবোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর গাড়ির বহরটিকে আটকে দেয়া হয়েছিল এবং তাকে কড়া প্রহরায় বিশেষ ব্যবস্থায় বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি কি জানেন? এই যে তাকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মেরে ফেলার এত বড় চক্রান্ত ধরা পড়ল সে ব্যাপারে কিন্তু তার মধ্যে কোনো ছাপ দেখতে পেলাম না সেদিন।’ রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আসলে হয়েছে কি জানেন? এত বড় বিশাল হৃদয়ের মানুষটির কথা বলতে গেলে অনেক স্মৃতিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, অনেকটা স্মৃতিকাতরতায়ও আক্রান্ত হই।’ (এ কথা বলতে বলতে এখন প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্তর চেহারাতেও কেমন যেন এক ধরনের বিষণ্নতা ভেসে উঠল)। তিনি বলেন, ‘সেই বোমা ডিসপোজাল ও নিষ্ক্রিয় করা শেষে অকুতোভয় সাহসী বঙ্গবন্ধু কিন্তু সাবলীলভাবে উদ্বোধন করলেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি। তবে আমরা সেই বোমাটি দেখতে পাইনি, কারণ সিকিউরিটির লোকজন তা সরিয়ে ফেলেছিলেন। আমার মনে প্রচণ্ড খটকা লাগল, কারা, কেন বঙ্গবন্ধুকে মারার জন্য এত নিরাপত্তার মধ্যেও এ ধরনের ষড়যন্ত্রটি করতে পেরেছিল? বুঝতে পারলাম আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ককে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সপরিবারে নৃশংস ও অমানবিকভাবে হত্যা করার পরে।’

সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২০

SUMMARY

2549-বঙ্গবন্ধু-৫.jpg