শিশুসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু

রহীম শাহ 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বনন্দিত আদর্শ, চেতনা ও দর্শনের একটি নাম। তার জন্ম হয়েছিল মধুমতি ও বাইগার বিধৌত, পাখির গানে মুখরিত অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। মহীয়সী এক জননীর কোল আলোকিত করে জন্ম নেয়া এ শিশুটির পরম আদরের নাম ‘খোকা’। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের প্রতিটি পথ-প্রান্তর যেন তাকে চেনে। সে গাঁয়ের মাটি তাকে চেনে। মধুমতি নদীতে সাঁতার কেটেই কেটেছে তার দুরন্ত শৈশব। সে শিশুর পায়ের আলতো স্পর্শে যেন ধন্য হয়েছে এ গাঁয়ের মাটিতে গজে ওঠা দূর্বাদল। মাটিও যেন তাকে ভালোবাসে। এ গাঁয়ের বাতাসে বিকশিত হয়েছে তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
অমর মহাকাব্যের কবি বঙ্গবন্ধু। বাইগার আর মধুমতীর জলে সিক্ত হয়ে যে খোকা একদিন কেঁদে উঠেছিল টুঙ্গীপাড়ায় সেই খোকাই সময়ের নদীর স্রোতে বেড়ে উঠে হয়ে যায় সকলের বঙ্গবন্ধু। উনিশশ ঊনসত্তর সালের উত্তাল দিনগুলোতে, চারদিকে যখন আগুনের ফুলকিতে তিলে তিলে মাতৃগর্ভে তৈরি হচ্ছিল মুক্তি, তখনই চট্টগ্রামের সন্তান ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের দেয়া উপাধিতে ইতিহাসের খ্যাতিমান খোকা নিমিষেই হয়ে ওঠেন সকলের ‘বঙ্গবন্ধু’। করিৎকর্মা তোফায়েল আহমদের কারণে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়া ছাপিয়ে। পৃথিবীর আরেক কীর্তিমান নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কাছে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন হিমালয়ের প্রতীক। ৭ মার্চের অনবদ্য ভাষণে নিউইয়র্কের নিউজ উইক ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনিই হয়ে উঠেন পৃথিবীর প্রথম ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’।
মুজিবকে নিয়ে সৃজনে-মননে ঘটেছে বিপ্লব। এই সৃজন বিপ্লবের শস্যরূপে আমরা পেয়েছি সহস্রাধিক গল্প, পেয়েছি অজস্র কবিতা, উপন্যাস ও গান। পেয়েছি নাটক, চলচ্চিত্র ও কাব্যনাট্য। ছড়া ও শিশুতোষ সাহিত্যে মুজিবের জীবন এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। গানে-প্রবন্ধে মুজিব ছড়িয়ে পড়েছেন মননশীল জগৎ হতে বিনোদন ও দেশাত্মবোধের অপ্রতিম সাম্রাজ্যে। প্রতিদিন আজো মুজিবকে নিয়ে নতুন কিছু না কিছু কেউ না কেউ সৃষ্টি করে চলেছেন। মুজিব আজ এক অনন্য সৃজন-বিপ্লবের নাম। মুজিবকে নিরন্তর সৃজনশস্যে আবিষ্কারের প্রয়াস আজ বর্ণিলভাবে বহমান।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল প্রথম উদিত হন রাঙা অরুণ হয়ে তাঁর ছোটোগল্প ‘আত্মহত্যা’য়। এমনিভাবে পরবর্তীতে তাঁর আরো অন্যান্য গল্প ‘ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’, ‘কান্না’, ‘নিহত ঘুম’ ইত্যাদিতে উঠে আসে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর এক বড়ো শুভাকাক্সক্ষী কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। তাঁর গল্প ‘দুই সখী’তে তিনি ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধুর অসময়োচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে এমনিভাবেই রচিত হয় আবু ইসহাকের ‘স্বপ্ন-সংবাদ’, হুমায়ুন আজাদের ‘যাদুকরের মৃত্যু’, অসীম সাহার ‘ভ্রুণ’, রাহাত খানের ‘দীর্ঘ অশ্রুপাত’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নেয়ামতকে নিয়ে গল্প নয়’ সেলিনা হোসেনের ‘ক্রোধ’, বিপ্রদাশ বড়–য়ার ‘ফিরে তাকাতেই দেখি’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’, ‘রাজার চিঠি’ ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’, রশীদ হায়দারের ‘এ নহে পতন’ খালেদ এদিব চৌধুরীর ‘রক্তে ভেজা দিন’, রশীদ হায়দারের ‘রাখালপুত্র ও রাজপুত্রের গল্প’, সৈয়দ ইকবালের ‘একদিন বঙ্গবন্ধু’, শরীফ খানের ‘নক্শি কাঁথায় শোকগাথা’, আমীরুল ইসলামের ‘ভয়ানক সকালের গল্প’, ইমতিয়ার শামীমের ‘যে ভোরে শিউলি ঝরে’, সারওয়ার-উল-ইসলামের ‘প্রিয় বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাসে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। এই ইতিহাস স্রষ্টাকে নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত হয়েছে পাঁচটি উপন্যাস। সৈয়দ শামসুল হকের ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’, হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’, সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের একরাত’, আনিসুল হকের ‘যারা ভোর এনেছিল’ ও ‘ঊষার দুয়ারে’। এর বাইরে মোস্তফা কামালের ‘জনক জননীর গল্প’ উপন্যাসটিতে জাতির পিতার সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে প্রথম উচ্চারণ করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। উনিশশ সাতাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসনের কড়া পাহারায় বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সফেদ শ্মশ্রুতে ঋষির অবয়বে তিনি পাঠ করেন, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ/গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি’।
এই সাহসী উচ্চারণ যেন এক লহমায় খুলে দিল ভীতির অর্গল। আর সেই মুক্ত দুয়ার দিয়ে অবমুক্ত হতে থাকল কবির মনে জমে থাকা একের পর এক কবিতা। কবি নির্মলেন্দু গুণই একমাত্র কবি যাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধু এসেছেন সর্বাধিকবার।
কবির ‘মুজিবমঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে মুজিবকে নিয়ে লেখা তিরিশটির মতো কবিতা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদ-’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ ইত্যাদি ।
বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান ‘ইলেকট্রার গান’ কবিতায় মুজিবকে নিয়ে রচনা করেন বেদনামথিত শোকবিলাপ। গ্রিক রাজা অ্যাগামেননের হত্যাকাণ্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে রূপকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট করে তিনি গভীর মমতায় কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন। তাঁর কবিতায় আমরা পাই,
‘নিহত পিতা, অ্যাগামেননের কবরে শায়িত আজ/আড়ালে বিলাপ করি একা/আমার সকল স্বপ্নেও তুমি/নিষিদ্ধ আজ তোমার দুহিতা একী গুরুভার বয়’।
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় আমরা পাই, ‘নমিত হৃদয় আজ/দিকে দিকে পতাকাও/নমিত সে শোকে/তেরশত নদী আজ/অশ্রু ঢালে কোটি কোটি মানুষের চোখে।’
জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের ‘ডাকিছে তোমারে’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘কোন ছবিগুলি’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বীর নেই’, ‘আছে শহিদ’, বেলাল চৌধুরীর ‘রক্তমাখা চরমপত্র’, মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’, শহিদ কাদরীর ‘হন্তারকের প্রতি’, হেলাল হাফিজের ‘নাম ভ‚মিকায়’, আসাদ চৌধুরীর ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’, ত্রিদিব দস্তিদারের ‘জনকের ছায়া’, সানাউল হকের ‘লোকান্তরে তুমি আত্মদানে’, আবিদ আনোয়ারের ‘প্রতিরোধ’ কবিতাগুলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক একটা কালের দলিল।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবীর চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, মযহারুল ইসলাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুল হোসেন, রোকনুজ্জামান খান, কায়সুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রুবী রহমান, মাহবুুব সাদিক, মনজুরে মওলা, নাসির আহমেদ, অসীম সাহা, মহীবুল আজিজ, মুহাম্মদ সামাদ, খালেদ হোসাইন, শামীম রেজা, আমিনুর রহমান সুলতান, সৌরভ জাহাঙ্গীর প্রমুখ। প্রতিবাদী কবি নূরুল হুদার সাহসী উচ্চারণ তার কবিতায়, ‘নেইতো তাহার জিভ/যে বলেনি জাতির পিতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। কবিতাতেই তিনি আরও বলেন, ‘চল্লিশ হাজার বছর পরে তোমার স্মরণ নেবে/তোমার বাঙালি’।
ছড়া একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ছড়ার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু আরও ছড়িয়ে পড়েছেন মানুষের হৃদয়ের গভীরে। অন্নদা শংকর রায়ের সেই অমর ছড়া আজও আমাদের প্রেরণা:
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন তুমি অমর রবে
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।’

ছড়াকার আনজীর লিটনের ছড়ায় আমরা পাই,
‘মুজিব ছাড়া বাংলা-বলো
কেমন করে মানতে পারি?
একটা জাতির একটা মুজিব
কোত্থেকে আর আনতে পারি?’

আবার আখতার হুসেনের ‘তুমি মুজিবর’ ছড়ায় আমরা পাই,
‘তুমি মুজিবর, আত্মার স্বর
তুমিই তো দেশ, তুমি প্রতি ঘর।’

ছড়াকার আমীরুল ইসলামের ছড়া ‘শেখ মুজিব’-এর চরণে চরণে আমরা পাই,
‘তুমি আমাদের হাজার বছরে
একটি আলোর দীপ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’
এমনিভাবে শিশুদের জন্য অজস্র ছড়া-কবিতায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে আজও জীবন্ত হয়ে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। ‘শেখ মুজিব : আমার পিতা’ গ্রন্থে আমরা নেতা ও পিতা মুজিবকে খুঁজে পাই। এছাড়াও বেবী মওদুদ ও শেখ হাসিনা সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি, উর্দু, মনিপুরী, জার্মান ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধু আজ ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবী।
একজন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উৎপাদিত সৃজনশস্যের ভাণ্ডার অসীম এবং ক্রমবর্ধিষ্ণু। বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালির নয়, পৃথিবীর সম্পদ। যতদিন যাবে ততই বঙ্গবন্ধু চর্চা বৃদ্ধি পাবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-কাব্য নিয়ে আজ গবেষণা-গ্রন্থ হয়েছে এবং তাঁর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের উৎস খোঁজা হচ্ছে।

সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০২০ 

SUMMARY

2545-বঙ্গবন্ধু৪.jpg