পুত্র ভাবত জেলই আব্বার বাড়ি

পিয়াস মজিদ
...আজ  আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই--বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। ... খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!... (পৃষ্ঠা : ২০৯, কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা)

সতেরো মার্চ ১৯৬৭-তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা এগারোটি মামলার আসামী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৪৭তম জন্মবার্ষিকীতে লিখেছেন এই কথা। ঠিক ৫০ বছর পর ২০১৭-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর বর্ণময় জীবনের কারাপঞ্জি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করল বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি। ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ মুজিবপত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছার রেখে দেওয়া চারটি খাতায় লেখা এই কারাভাষ্য।

১৯৫৮ থেকে ১৯৬০, এই পর্বের রোজনামচা ‘থালা বাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল’ শিরোনাম পেয়েছে। ১৯৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে ৮ মে পুনরায় গ্রেফতার হন। পর পর দুই বছরের কারালিপি দুটো খাতায় লিখেছিলেন। ১৯৬৮-এর ১৮ জানুয়ারি কারামুক্তির পরই তাঁকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগেই তাঁর বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা’র ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। এই মামলায় বন্দি অবস্থার বিবরণ অর্ন্তভুক্ত হয়েছে গ্রন্থের শেষাংশে।

স্মৃতিঘন ভূমিকায় শেখ হাসিনা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে এবং ১৯৮১-তে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে কী ভাবে পিতার লেখার খাতা উদ্ধার করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন। কারাগারের রোজনামচায় যে স্নেহময় পিতা তার জ্যেষ্ঠা কন্যা ‘হাসিনা’র পরীক্ষা, বিয়ে ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন, সেই কন্যা শেখ হাসিনাই ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিয়োগান্ত মৃত্যুর পর তাঁর রাজনীতির হাল ধরলেন।

দার্শনিক প্রাজ্ঞতায় মুজিব বলেছেন ‘জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে’। তিনি শুধু নিজের কারাজীবনের স্মৃতিচারণ করেননি; একই সঙ্গে সামগ্রিক কারাব্যবস্থা ও কারাবন্দিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এমন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন যা সহজেই হতে পারে কারাবিষয়ক গভীর গবেষণার উৎস। আদ্যন্ত এক জন পড়ুয়া মানুষ ছিলেন। তার প্রমাণ, এমিল জোলা, হেনরি ডেভিড থোরো শরৎচন্দ্র কিংবা শহীদুল্লা কায়সারের বইপত্র প্রসঙ্গে। পাশাপাশি রবীন্দ্রপ্রেমী এক রাজনীতিকের দেখা পাবেন পাঠক, যে রাজনীতিক কারাবন্দি অবস্থায় যে কোনও হতাশ মুহূর্তে শরণ নেন ‘...বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ এমন রবীন্দ্রবাক্যের।

কারাগারে সীমিত সুযোগে গোগ্রাসে পত্রপত্রিকা পড়তেন তিনি। ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট বক্তৃতা পাঠ করে তখনকার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন ‘শোয়েব সাহেব শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে ভোগের ব্যবস্থা রাখিয়াছেন। কিন্তু গরিব জনসাধারণ বোধহয় আর আলো জ্বালাইয়া রাতের খাবার খেতে পারবে না।‘  শেখ মুজিব জেনেছিলেন সে বাজেটে কেরোসিন তেলের উপর বাড়তি কর ধার্য হয়েছিল।

কারাগারে মায়ের অসুস্থতার সংবাদ শুনেছেন, পিতা-বিচ্ছিন্ন সন্তানদের হাহাকার প্রত্যক্ষ করেছেন। এমনও হয়েছে আঠারো মাসের শিশুপুত্র রাসেল জন্মের পর থেকে পিতাকে কারাগারে থাকতে দেখে কারাগারকে বলত ‘আব্বার বাড়ি’। পরিবারের এই পরিস্থিতিতেও কারাকুঠুরিতে রান্না করেছেন, সহ-কারাভোগীদের সুখ-দুঃখের জীবনকথা জেনেছেন, সর্বক্ষণ ভেবেছেন গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক অধিকার আর দেশের সার্বিক মঙ্গলের কথা। খাঁটি জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন বলে কারাবন্দি মুজিবকে স্পর্শ করেছে প্রবল আন্তর্জাতিকতাবাদ। ১৯৬৬-এর চোদ্দো জুলাই স্মরণ করেছেন ১৭৭তম ফরাসি বিপ্লব দিবসকে। লিখছেন ‘কারাগারে এই নির্জন কুঠিতে বসে আমি সালাম জানাই সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের, যারা প্যারি শহরে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিলেন।’ কারাগারের রোজনামচা পড়ে শেখ হাসিনার মতো আমাদেরও মনে হবে ‘এ ডায়েরি পড়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাবে।’ 

গবেষক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
সুত্র: আনন্দবাজার, প্রকাশ: ২৫ মার্চ , ২০১৭

SUMMARY

2516-১.jpg