রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই থেকে জয় বাংলা। বাহান্ন সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা। এ ভাবেই বাঙালি ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জনের লড়াই সংগ্রামের পথ ধরে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে একুশের শহিদরা রক্তের বিনিময়ে যে পথ রচনা করেছিলেন সেই পথ ধরেই একুশের শহিদদের স্বপ্ন ও আদর্শকে সম্বল করে এক দিন বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্ত দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
অমর একুশের প্রত্যয় সব অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্তি। ভাষার অবিনাশী শক্তি মানুষের আত্মিক মুক্তি, সৃজনশীল বিকাশ এবং তার মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ভাবে সম্পর্কিত। ভাষার এই মুক্তিই বাংলাদেশের মানুষকে বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত নিয়ে গেছে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। এই লক্ষ্য অর্জন করেছে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের লড়াই সংগ্রাম এবং একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১— এই সময়ের মধ্যে অনেকগুলো বাঁক পেরোতে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে।অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্তের মধ্য দিয়ে পেরোতে হয়েছে। ইতিহাসের এক নির্মম ও রক্তাক্ত অধ্যায় ছিল ১৯৪৭ সালে জিন্নাহর ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশের বিভক্তি। এই রক্তাক্ত অধ্যায়টির মধ্যে একটি বড় প্রহসন ছিল। প্রহসনটি হচ্ছে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীই পাকিস্তান গঠনের পক্ষে নিরঙ্কুশ ভাবে ভোট দিয়েছিল, কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই ‘সাধের পাকিস্তান’ সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটে বাঙালির। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ যখন বললেন ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা’, তখনই পাকিস্তান সম্পর্কে পূর্ববাংলার বাঙালির মোহভঙ্গ ঘটে। রুখে দাড়ায় বাঙালি। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে একটি বিস্মকর তথ্য হল পুরনো ঢাকার মানুষ যাদের সাধারণত ‘ঢাকাইয়া কুট্টি’ বলা হয়, এরা এক ধরনের অশুদ্ধ উর্দুতে কথা বলে, এরাও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রীতিমতো লড়াই করেছে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এ থেকে ভাষার লড়াইয়ের ব্যাপ্তিটা বোঝা যায়।
’৫২ সালে ভাষার সংগ্রাম চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। সেই শুরু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের।
পাকিস্তানের ওপর এর পরের বড় আঘাতটি ছিল ১৯৫৪ সালে। পূর্ব বাংলাকে তখন পূর্ব পাকিস্তান করে ফেলেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নিবার্চন হয় এই বছরে, ভারত ভাগের পরে পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচন। ভরাডুবি হল পাকিস্তানের ‘প্রতিষ্ঠাতা দল মুসলিম লিগের’। প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে মুসলিম লিগ পেয়েছিল মাত্র নয়টি আসন।অবশিষ্ট ৩০০ আসনে বিজয়ী হয় আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নৌকা প্রতীক নিয়ে। সেই যে হার, এর পর আর কোনও সময়েই মুসলিম লিগ এই দেশের রাজনীতিতে তাদের পূর্ব অবস্থা ফিরে পায়নি। বলা যায়, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা দলটি দেশটির একটি প্রদেশ থেকে নির্মূল হয়ে গেল। সেই যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লিগের পরাজয় হল, সেটাই সূচনা করল স্বাধীন বাংলাদেশ অভিমুখে বাঙালির যাত্রার।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের যন্ত্রণা
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। একের পর এক সামরিক শাসন, পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ভেঙে দেওয়া (’৫৪ সালের নির্বাচিত সরকার), স্বৈরশাসন, গণতন্ত্র হরণ, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না দেওয়া, ষড়যন্ত্র করে সরকারের পরিবর্তন করা হয়েছে। শপথ নেওয়া ৫৬ দিন পর প্রথমে ভেঙে দেওয়া হল যুক্তফ্রন্ট সরকার। ৯২ক ধারা জারি করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করা হয়। এর পর ১৯৫৮ সালে প্রথম সামরিক শাসন। এটা আয়ুব খানের সামরিক শাসন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে পরোক্ষ ভোটের এক তথাকথিত গণতন্ত্র চালু করে, যেখানে আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী (জনগণের ভোটে নির্বাচিত) ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি দিন গণতন্ত্রের এই প্রহসন মেনে নেয়নি। ১৯৬২ সালেই আয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে বাংলার মানুষ। ধারাবাহিক ভাবে ১৯৬৩, ১৯৬৬ এবং ১৯৬৯-এর ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে আয়ুব খানের পতন ঘটে।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসখ্যাত ছ’দফা দাবি ঘোষণা করেছেন। এর মূল দাবি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক সম্পর্ক ব্যতীত সব থাকবে প্রদেশের হাতে ও দুটো থাকবে কেন্দ্রের হাতে। সরকার পদ্ধতি হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ফেডারেল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর যে চরিত্র, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই শেখ মুজিবের ৬-দফা মেনে নেয়নি। ছয় দফার পক্ষে বাংলার মানুষকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শেখ মুজিব সারা প্রদেশ ঘুরে বেড়ান, চারণের মতো জনসভা করেন। পাকিস্তান সরকার চণ্ড দমননীতি চালিয়ে শেখ মুজিব-সহ আওয়ামি লিগের প্রথম সারির সকল নেতাকে গ্রেফতার করে। মুজিব-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। যেখানে অভিযোগ করা হয় ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন এবং ষড়যন্ত্রটি করা হয়েছে আগরতলায় বসে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ১৯৬৯-এর ৬ দফা-১১ দফার আন্দোলনের ফলে আয়ুব খান বাধ্য হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিব-সহ সব অভিযুক্তকে নিঃশর্তে মুক্তি দিতে। এর পর পরই আয়ুব খানের পতন ঘটে।
আর এক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে আবার সামরিক শাসন জারি করেন। তবে যেহেতু আন্দোলনের চাপ ছিল, তাই ইয়াহিয়া খান প্রথম বারের মতো সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানে নির্বাচন করতে দিতে বাধ্য হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। আমতলায় সভা। ছবি: সংগৃহীত।
নির্বাচনে আবার ভরাডুবি হয় পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৭ আসনের মধ্যে দুটি ব্যতীত জাতীয় পরিষদের অন্য আসনগুলিতে আওয়ামি লিগ বিজয়ী হয়। নির্বাচনে শেখ মুজিব এবং আওয়ামি লিগের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু ছিল ৬-দফা। পাকিস্তানি রাজনীতিকরা ৬-দফার বিরুদ্ধে প্রচার করে: আওয়ামি লিগের ৬-দফা পাকিস্তান ভাঙার জন্য দেওয়া হয়েছে। এ সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আওয়ামি লিগ বা ৬-দফার পক্ষেই ম্যান্ডেট দিয়েছে ১৯৭০-এর নির্বাচনে।
এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং রাজনীতিকরা। ষড়যন্ত্র করা হয় বাঙালির বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেও বাতিল করা হয়। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিলে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন তার প্রধান প্রধান সামরিক কর্তাদের নিয়ে। ইতিমধ্যে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির সমাবেশে আহ্বান জানান, “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবা।... রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেব, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব...এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বাঙালি প্রস্তুত হতে থাকল স্বাধীনতার লড়াই লড়বার জন্য। সে এক অভূতপূর্ব সময়। ঘরে ঘরে আলোচনা স্বাধীনতার, ঘরে ঘরে প্রস্তুতি স্বাধীনতার। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়। ২৫ মার্চ (১৯৭১) পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘুমিয়ে থাকা নিরস্ত্র বাঙালির উপর সশস্ত্র আক্রমণ করল। লক্ষ্য একটাই, বাঙালিকে নিঃশেষ করবে, পদানত করবে। ওরা বলল পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ চাই না, মাটি চাই। সেই নৃশংসতার কথা সারা দুনিয়া জানে।
শুরু হয়ে গেলে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা পর্যন্ত বাঙালির দীর্ঘ রক্তাক্ত যাত্রার চূড়ান্ত পর্ব। যে যাত্রায় আবারও বিজয়ী হয়েছে বাঙালি।
বাঙালির কাছে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’।
সুত্র: আনন্দবাজার, প্রকাশ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭