বিরূপ বিশ্বে তিনি নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে

পিয়াস মজিদ

১৭ মার্চ ২০১৯ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন। তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে ১৭ মার্চ ২০২০-তে। এ বছর থেকেই শুরু হয়েছে বর্ষব্যাপী জন্মশতবর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা। তবে এ সব আনুষ্ঠনিকতার ভিড়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কতটুকু খুঁজে পাওয়া যাবে? সেই শেখ মুজিব, যিনি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের গণমঞ্চ থেকে বাংলার আপামর জনতা কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। সত্যি তিনি বন্ধু, ত্রাতা ও নেতার অধিক প্রাণের বন্ধু তিনি বাংলা ও বাঙালির। অনধিক ষাট বছরের জীবদ্দশায় তাঁর আন্দোলন, অভীপ্সা ও অর্জন বিস্ময়-জাগানিয়া।

তাঁকে এত দিন আমরা, তরুণ প্রজন্ম জেনেছি ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ পাওয়া তাঁর দু’টি বই— অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা প্রকাশের পর আবিষ্কার করছি লেখক হিসাবে তাঁর গভীরতার স্বরূপ। সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি— সব কিছুকে এক বৃহৎ দার্শনিক প্রেক্ষিতে বিচারের বিষয়টি লক্ষ করি তাঁর নিরূপম রচনায়।


পাকিস্তানি রাজনীতিক দরবারের খাজা-গজা, খানবাহাদুর-নায়েব নাজিমের কবল থেকে রাজনীতিকে তিনি নিয়ে এসেছেন সাধারণ খেটে খাওয়াদের দোরগোড়ায়। প্রান্তিক মানুষের দাবিদাওয়াকে পরিণত করেছেন রাজনীতির কেন্দ্রীয় ইস্যুতে। পেশ করেছেন পূর্ববাংলার মানুষের বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অত্যল্পকাল পর থেকেই সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে গৌণ করে দিয়ে জনতার সামনে বাঙালি জাতীয়তার পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছেন।


আরও পড়ুন: নির্মম হত্যার পরেও তিনি থেকে গেলেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে​


১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট তাঁর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের চুয়াল্লিশ বছর পর যদি ফিরে তাকাই তবে আমাদের অনেক অর্জন সত্ত্বেও হতাশই হতে হবে আসলে। আমরা তাঁর কথা মুখে বলি, তাঁর নামে হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ি, কিন্তু বাস্তবে তাঁর আদর্শের কতটা অনুগামী আমরা?

৭ মার্চের সেই দুনিয়া-কাঁপানো ভাষণে তিনি যেমন তাঁর জনগোষ্ঠীর ন্যায্য দাবিদাওয়ার কথা বজ্রকণ্ঠে তুলে ধরেছেন, তেমনই বলেছিলেন, ‘কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি এক জনও হন।’ আজ আমরা কী দেখছি! ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব সর্বক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ। ন্যায্য কথা বলার চেয়ে সুযোগ বুঝে সর্বাত্মক সমর্পণকে যে সময়ে প্রধান প্রবণতা হিসেবে দেখা যায় তার পরিণতি কি কখনও শুভকর কিছু হতে পারে?


৭ মার্চের সেই দুনিয়া-কাঁপানো ভাষণে তাঁর জনগোষ্ঠীর ন্যায্য দাবিদাওয়ার কথা বজ্রকণ্ঠে তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

তিনি সে ভাষণে আরও বলেছিলেন, ‘বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’ আমরা কি স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরও বঙ্গবন্ধুর অর্পিত এ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? মনে হয় না। সমাজের সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যেতে হবে আরও বহু দূর। আমরা প্রায়শই সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়ে নাগরিকদের মাঝে সুযোগ ও অধিকারের বৈষম্য তৈরি করি যা কোনও ভাবেই বঙ্গবন্ধুর আর্দশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের দেশপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বিভিন্ন ভাষণ-বক্তৃতায় বলতেন, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ কখনও দুর্নীতি করে না, বরং দুর্নীতি করে তথাকথিত শিক্ষিত-সচেতন মানুষ। আজ আমরা দেখি দুর্নীতিগ্রস্থ রাঘববোয়ালের দল জমিদখল, নদীদখল, ঋণ খেলাপ করে পার পেয়ে যায় অবলীলায় আর সাধারণ মানুষের বঞ্চনার বৃত্তান্ত বেড়েই চলে দিনকে দিন। বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র ভাঙার কোনও বিকল্প নেই।

তিনি সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের কথা বলে এসেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই। ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর পর এক সম্মেলনে চিন ভ্রমণে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসুর। সে সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি শেখ মুজিব বাংলায় বক্তৃতা করেছেন যা মনোজ বসুকে মুগ্ধ করে। স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধু জানাচ্ছেন মনোজ বসুর প্রতিক্রিয়া: ‘আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষা বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে না। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’

জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলার মর্যাদা, কিন্তু আমরা সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন এবং মাতৃভাষার শুদ্ধ ও যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক ভ্রমণে গিয়ে নৌপথে আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনার অনুপম অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কলমে, ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’

নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি তাঁর এই আযৌবন অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনে, ১৯৭৪ সালে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে, দেশীয় চলচ্চিত্র, নাটক ও ললিতকলার পৃষ্টপোষণায়। কিন্তু আমরা আজ কার্যক্ষেত্রে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন থেকে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতিভাবনার পথ থেকেই সরে এসেছি অনেকটা।

আরও পড়ুন: নির্মম হত্যার পরেও তিনি থেকে গেলেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে

ধর্মের নামে রাজনীতিকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইহজাগতিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-বিজ্ঞানবিরোধী অপশক্তির সঙ্গে আপোসের রাস্তা বেছে নিয়েছি প্রায়শই যার পরিণাম কখনওই ইতিবাচক হয়নি।

বঙ্গবন্ধু নিজেকে অলৌকিক একক না ভেবে গুণী পরম্পরার সন্তান জ্ঞান করতেন। তাই তাঁর যে কোনও বক্তৃতায় উঠে আসত মহাত্মা গাঁধী, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সুরাবর্দী প্রমুখ প্রিয় পূর্বজদের কথা। আমরাও আজ বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে যেন ভুলে না যাই তাঁর মহান প্রেক্ষাপটের কথা, তাঁর প্রেরণার মানুষদের কথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে শান্তি কোনও কৌশল ছিলো না, ছিল তাঁর প্রিয় মানুষের জন্য আকাঙ্খিত অবিকল্প উপচার। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

বিরূপ বিশ্বে দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাবে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংকল্প উচ্চারণ করেছেন, আমরা সে রকম সাহসী জায়গায় থাকতে পারি না বরং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রেও সন্ধান করি সমীকরণ। শান্তি তাঁর কাছে কোনও কৌশল ছিলো না, ছিল তাঁর প্রিয় মানুষের জন্য আকাঙ্খিত অবিকল্প উপচার। আমাদেরও অনুসরণ করতে হবে এই পথ।

তিনি তাঁর রচনায় বলেছেন যে কাজ করে সে ভুলও করে, আর যে কাজ করে না তার ভুল-শুদ্ধ কোনওটাই হওয়ার সুযোগ নেই। এই কথাটি ভেতর থেকে বিশ্বাস এবং প্রতিপালন করলে যে কোনও দেশের সামনেই আশাবাদী ভবিষ্য ব্যতীত অন্য কিছু অপেক্ষা করার কথা নয়।

বঙ্গবন্ধু গভীর ভাবে রবীন্দ্রপ্রেমী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করতেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। ১৯৭২ সালে তাঁকে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জিজ্ঞাস করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি’। তিনি আবার জানতে চেয়েছেন, আর আপনার দুর্বল দিকটা কী? তাঁর উত্তর ছিল, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি’। এই ভালোবাসার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে দেশবিরোধী মনুষ্যত্ববিরোধী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মম ভাবে প্রাণ দিয়ে। তবু আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষকে ভালবাসার শক্তিতে।

তিনি জীবনের এক বড় অংশ কাটিয়েছেন পাকিস্তানি জেলখানার অন্ধকারে। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু বাগান করতে ভালবাসতেন। আজ আমরা উন্মুক্ত-স্বাধীন ঘোরাফেরা করেও মানসিক ভাবে জেলখানায় বন্দি না থেকে যেন বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষের জীবনে কাম্য সুরভির বাগান তৈরির সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারি, এই হোক ১৭ই মার্চ পুণ্যতিথির প্রধান প্রত্যয়।
সুত্র: আনন্দবাজার, প্রকাশ: ১৭ মার্চ , ২০১৯

SUMMARY

2513-১.jpg