বাংলার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা জানতে মুজিবকে বুকের ভেতর রাখা জরুরি
পুরো বাংলা আর বাংলাদেশটাই ধারণ করে রয়েছে শেখ মুজিবের অবয়ব।
লিখছেন হামিদ কায়সার।
বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার প্রকৃতি রোদ হাওয়া তার আপন প্রয়োজনেই জন্ম দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, কেননা তাঁর জন্ম না হলে বাংলা মা খুঁজে পেত না নিজের সার্বভৌম ঠিকানা। হ্যাঁ, শেখ মুজিবুর নামের প্রচণ্ড আবেগের বিস্ফোরণেই যেমন অভ্যুদয় হয়েছিল বাংলাদেশ নামে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের, তেমনই এ দেশের প্রকৃতিও যেন নিজ হাতে গোপালগঞ্জের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানকে ধীরে ধীরে তৈরি করে দিয়েছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে! শুধু কি অবিসংবাদিত নেতা? বিশ্বের যুগান্ত সৃষ্টিকারী যত নেতা রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে অনায়াসে যুক্ত করা যায় তাঁর নাম। হয়তো লেনিন, চার্চিল বা নেহরুর মতো ধী-শক্তি আর প্রজ্ঞা ছিল না, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বের কারণে তাঁর নাম অবলীলায় স্থান পাবে হো চি মিন, সুকর্ণ কিংবা নাসেরের সঙ্গে!
আজকের প্রজন্মের কোনও বাঙালি তরুণ কল্পনাও করতে পারবেন না, বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা একদা কতটা সাগরের ঢেউয়ের মতো উত্তাল ছিল, কতটা বিস্তৃত ছিল আকাশের পরিসীমার মতো! যার সূচনা ঘটেছিল চল্লিশের দশকের শেষ প্রান্ত থেকেই। তার পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতেই যেন, তার নেতৃত্বের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল বাহান্ন সালের মহান একুশের ভাষা আন্দোলনের চেতনার স্ফূরণের ভেতর দিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যতই উপলব্ধি করতে পারল মাতৃভাষাকে লালন করতে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে পালন করতে স্বাধীনতার কোনও বিকল্প নেই, শোষণ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য লড়াই অবশ্যম্ভাবী— ততই যেন বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠলেন তাঁদের মানসনেতায়। ঘটনা পরম্পরায় সত্তরের নির্বাচনকে ঘিরে তিনি রূপান্তরিত হলেন বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীকে। তাঁকে ঘিরেই অবয়ব পেল বাঙালি জাতিসত্তা, ঐক্যবদ্ধ হল বাঙালি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। রচিত হল বাঙালি জাতির মুক্তির পথ।
এই যে একমাত্র স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রের উদ্বোধন হল তাঁর মাধ্যমে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লক্ষণীয় যে, বাঙালির আত্মার সঙ্গে তাঁর সংযোগটা যে কত নিবিড় আর গভীর তা ধরা পড়েছিল সেই চল্লিশের দশকের শেষপাদেই, যখন তিনি কেবল তারুণ্যের স্পর্ধিত অলংকার নিজের মধ্যে ধারণ করতে শুরু করেছেন! সে সময়ের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলেই যা পরিষ্কার হবে। কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কর্মকর্তা অজয়কুমার দে-র স্মৃতিগ্রন্থ ডাউন ফেডিং মেমোরি থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই গোপালগঞ্জ থেকে ছুটে গিয়েছিলেন বাঙালির পরম আত্মীয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে!
সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ছুটে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
২০০০ সালে প্রকাশিত ডাউন ফেডিং মেমোরি গ্রন্থ থেকে একটি অংশ ২০০৪ সালে অনূদিত হয়েছিল বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদের ২৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা যাক, ‘আমার স্মৃতি যদি ঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে ১৯৩৪ বা ১৯৩৫ সাল হবে, যেহেতু আমি ডায়েরি রাখিনি, সুভাষ চন্দ্র বসু, যিনি পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষ নামে খ্যাত, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে তিক্ত সমালোচক ও শত্রু, কতিপয় ধারায় গ্রেফতার হয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে হেনরি মার্টিন ব্লকের একটি কেবিনে ভর্তি ছিলেন...আমার বিশেষ দায়িত্ব ছিল শ্রী বসুর সঙ্গে বহিরাগত কারও সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া। তার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকার খবর স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রতিদিনই আমাকে এ ধরনের সাক্ষাৎ প্রার্থীকে থামাতে হতো।…একদিন সকাল দশটার দিকে একজন উঠতি বয়সের তরুণ শ্রী বসুর সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদনপত্র পাঠায়। আমি হাসপাতালের বড় সিঁড়ির কাছে দক্ষিণ পাশে তার সাথে দেখা করি। তখন স্যার জন এন্ডারসন জরুরি ভবন নির্মিত হয়নি। আমি এসে দেখলাম সেই যুবকের বয়স ১৬/১৭ বছর হতে পারে। সে সাধারণ পাজামা ও শার্ট পরিহিত ছিল। আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, একটি স্কুলে ক্লাশ নাইন বা টেনে পড়ে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন সে শ্রী বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। সে বলল শ্রী সুভাষ বসুর বীরত্বের সে একজন ভক্ত, অনুরাগী। যেহেতু এই ভারতীয় মহান নেতা মানুষের প্রতি কোনো ভেদাভেদ করে না, তাই সে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চায়। লেখাপড়ায় আরো মনোযোগ দেয়ার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়ে আমি তাকে ফিরে যেতে বললাম। আমার শুভেচ্ছা নিয়ে সে চলে গেল।’
সে দিন ফিরে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু অদম্য মুজিব ঠিকই দেখা করে ছেড়েছিলেন সুভাষ বসুর সঙ্গে। আবারও অজয় কুমার দে-র ডাউন ফেডিং মেমোরি লেন থেকে উদ্ধৃতি, ‘কিছুদিন পর সুভাষ চন্দ্র বসুর ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতে দর্শণার্থীদের শনাক্ত ও নজর রাখার কাজে আমাকে ডিউটি দেয়া হয়। সুভাষ বসু তখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এখানেও শেখ মুজিবুর রহমান নামে যুবকের দেখা পেয়ে অবাক হলাম। যখন সে ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে অনুসরণ করে এলগিন রোড পোস্ট অফিস পর্যন্ত যাই এবং তাকে জিজ্ঞাসা করি এবার শ্রী বসুর সঙ্গে তার সাক্ষাতের কারণ কি? সে সহজভাবে বলল, সুভাষ বসুর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা।’
আরও পড়ুন: নির্মম হত্যার পরেও তিনি থেকে গেলেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে
অজয় কুমার দে ঘটনাকাল ১৯৩৪-’৩৫ সাল উল্লেখ করলেও সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃত ঘটনাকাল ১৯৪০ সাল বলে শনাক্ত হয়েছে। সে বছরই ২ জুলাই সুভাষ বসুকে শেষবারের মতো গ্রেফতার করে হাসপাতালে অন্তরীণ রাখা হয়। এই যে সুভাষ বসু মিথে পরিণত হওয়ার আগেই তার প্রতি মুজিবের তীব্র আকর্ষণ বা অনুরাগ এটা নিছক আবেগপ্রসূত নয়, এটি ছিল তরুণ মুজিবুরের ভবিষ্যতে একজন অসাম্প্রদায়িক, প্রতিবাদী চেতনার এবং সর্বোপরি বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা হয়ে ওঠার সূর্যপ্রদীপ্ত পূর্বাভাসও।
যে সুভাষের প্রতি শেখ মুজিবুর এতটা আকৃষ্ট ছিলেন, কাকতালীয় ব্যাপার, সেই সুভাষ ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা থেকে অন্তর্হিত হলেন, আর তার অল্পকাল পরই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন ভবিতব্যের বাঙালি জাতির নব উথ্থানের স্বপ্নদাতা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের কথা বলতে গিয়ে সুভাষের কথা এ-কারণেই আসছে যে, সুভাষ ছিলেন বাঙালি জাতির আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা। যিনি জীবিত থাকলে হয়তো বাঙালির ইতিহাস আজ অন্য ভাবে লেখা হতে পারতো। যার প্রবাহমানতা পরবর্তীতে বয়ে নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু।
সুভাষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই অনুরাগ শুধু তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর প্রতিবাদী সত্তারই প্রকাশ নয়, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি স্বরাগ স্ফুরিত প্রেমও, যার ধারা অব্যাহত ছিল আজন্মকাল। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভারতের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফর করেন। আটই ফেব্রুয়ারি কলকাতার বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত বিশাল জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানিদের আমি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলাম যে, ভুলে যেও না এ-বাংলা তিতুমীরের বাংলা, ভুলে যেও না এ-বাংলা সূর্য সেনের বাংলা, ভুলে যেও না এ-বাংলা নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের বাংলা, ভুলে যেও না এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাংলা, ভুলে যেও না সোহরাবর্দির বাংলা।’ এই সফরকালে তিনি সরকারি প্রোটোকলের বাইরে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভাস্কর্যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। সেটা ছিল এমন এক সময়, যখন ভারতে সুভাষ বসু বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত।
ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে পা রাখেন মুজিব। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
১৯৪১ সালে কলকাতা থেকে সুভাষ বসুর অন্তর্ধান ঘটল, আর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে অভ্যুদয় হল বাঙালির প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবের। মুজিব যে জন্ম থেকেই বাগ্মী, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসায় সমর্পিত, অসাম্প্রদায়িক সর্বোপরি রক্তে-মাংসে-মজ্জায় বাঙালি তা প্রকাশ পেতে সময় লাগল না। অচিরেই ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষকদের সুনজরে পড়লেন, রাজনীতির ক্ষেত্রেও দেখাতে লাগলেন পারঙ্গমতা। আবুল হাশিম তো বটেই, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সোহরাবর্দির নৈকট্যও লাভ করলেন সহজে। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে শুরু হল তাঁর দ্রুত উত্থান। সোহরাবর্দির ছায়াতলে থেকেও আপন ভাবধারায় তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন। সে কারণেই ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হল, পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে মুজিবের রাজনীতি উদ্ভাসিত হতে লাগলো স্বমহিমায়। পাকিস্তানিদের কাছে যে এদেশের মানুষ শোষিত হচ্ছে, বাংলা সংস্কৃতি যে বিপদাপন্ন, বুঝতে সময় লাগেনি মুজিবের। তাই অনিবার্য ভাবেই যেন দেশভাগের এক বছর পরেই, ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম বারের মতো গ্রেফতার হন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যেমন দেখতে পেল শেখ মুজিবুরের তর্জনীর ঝলক, বাংলার জনগণও যেন টের পেল তাদের মুক্তিদাতার আগমনী বার্তা। শুরু হল বাংলার জনগণ ও শেখ মুজিবের যুগপৎ সংগ্রামের সাধনা, সেই সাধনা সফল পরিণতি পেল ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের মাধ্যমে।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির চার বছর যেতে না যেতেই যারা হত্যা করতে চেয়েছিল মুজিবকে, তাদের জানা ছিল না, পুরো বাংলা আর বাংলাদেশটাই ধারণ করে রয়েছে শেখ মুজিবের অবয়ব, তার অস্তিত্ব কখনও মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বরঞ্চ দিন যত যাবে, বাংলা আর বাঙালির কাছে ততই মহান হয়ে উঠবেন তাদের প্রাণপুরুষ, সকল বিতর্ক উর্ধ্বে ঠেলে আজ নেতাজি সুভাষ বসুও যেমন হয়ে উঠেছেন মহান। বাংলার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা জানার জন্য মুজিবকে বুকের ভেতর রাখাটা শুধু জরুরিই নয়, বিকল্পহীনও।
(হামিদ কায়সার সাহিত্যিক)