বাদশাহ ফয়সাল হওয়া অত সোজা নয়

হামিদ মীর
 
সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবিকই পার্লামেন্টকে নিতে হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। সৌদি আরব আর ইয়েমেনের বিরোধে পাকিস্তান কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী হবে না। বরং পাকিস্তান ও তুরস্ক উভয়ে তৃতীয় প হয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করবে। সৌদি আরব পাকিস্তানের কাছে বেশ স্পষ্ট ভাষায় সেনা সাহায্য চেয়েছে। পাকিস্তানের পে তা অস্বীকার করা বেশ কঠিন। সাধারণ প্রতিক্রিয়াও এটা বলে যে, পাকিস্তান অস্বীকার করতে পারবে না। পাশ্চাত্য মিডিয়া তো এ দাবি করেই বসেছে, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমান ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। পাকিস্তান ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তান সরকার নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পার্লামেন্টের দু’করেই বৈঠক ডাক দেয়। পার্লামেন্টের যৌথ বৈঠকের আগেই এ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের জনমতের বেশির ভাগ অংশই আরবদের পরস্পর নিজেদের বিরোধে কোনো একটি পরে প নিয়ে অপরজনের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার বিরোধী। সরকারের প থেকে বারবার এটা বলা হচ্ছে, যদি সৌদি আরবের নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে 
পাকিস্তান যেকোনো মূল্যে সৌদি আরবের প্রতিরা নিশ্চিত করবে। এ দিকে প্রতিরামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ এ বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সৌদি আরব বা হারামাইন শরিফাইনের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। সৌদি আরব পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র, এ 
বাস্তবতায় কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সৌদি আরবের ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। তবে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের বিরোধের মধ্যে জড়িয়ে পড়াতে 
পাকিস্তানের কোনো স্বার্থ নেই। 
এই বিরোধের কয়েকটি দিক রয়েছে। বিরোধের একটি দিক হচ্ছে, আরব দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে এক কাতারে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আল্লাহ না করুক, এ প্রচেষ্টা সফল হলে মুসলিম দেশগুলোতে গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা বেশ মুশকিল। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা সেই আদায় করতে পারে, যার ভূমিকার মধ্যে থাকবে সাহসিকতা এবং চালচলনে থাকবে বুদ্ধিমত্তা ও গাম্ভীর্যতা। পাকিস্তানের পার্লামেন্টের যৌথ বৈঠকে সার্বিকভাবে ওই গাম্ভীর্যতা ল করা যায়নি, যা কোনো মধ্যস্থতাকারীর চালচলনে প্রদর্শন করা উচিত। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, মধ্যস্থতাকারী নিজেই তার নিরাপত্তা নিয়ে সাাৎ বিপদগুলো মোকাবেলায় 
ব্যস্ত। যতণ পর্যন্ত মধ্যস্থতাকারীর নিজের অবস্থান দৃঢ় না হবে, ততণ পর্যন্ত সে নিজে আন্তর্জাতিক বিরোধপূর্ণ দু’টি পরে মাঝে সমস্যাগুলো কিভাবে নিরসন করবে? এ ধরনের বিরোধে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের জন্য বাদশাহ ফয়সালের মতো সাহসিকতা, বিচণতা ও গাম্ভীর্যতা থাকা প্রয়োজন। মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের ওপর দৃষ্টি বুলান। আজকের যুগে বাদশাহ ফয়সালের মতো সাহসিকতা, বিচণতা ও গাম্ভীর্যতা আপনি কোনো শাসকের মাঝেই পাবেন না। বাদশাহ ফয়সাল যদি না থাকতেন তাহলে হয়তো কোনো দিন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠত না। বাদশাহ ফয়সাল যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো সৌদি আরব ও ইয়েমেনের সম্পর্কের অবনতি ঘটত না।
তিনি সেই বাদশাহ ফয়সাল, যিনি ১৯৬৯ সালে মুসলিম দেশগুলোকে ওআইসির প্লাটফর্মে এক করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের প নিলে বাদশাহ ফয়সাল পশ্চিমা দেশগুলোতে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেন। সৌদি সরকারের প থেকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার পর 
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও জীবনব্যবস্থা হেলে পড়ে। বাদশাহ ফয়সাল মুসলিম দেশগুলোর একতাকে প্রভাবশালী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি সমস্যা ছিল পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে যাওয়া। 
পাকিস্তানের নব্বই হাজার যুদ্ধবন্দী ভারতের কাছে ছিল। আবার পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে দাবি জানাচ্ছিল, ১৯৭১ সালের সেনা অভিযানের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের তাদের কাছে সমর্পণ করা হোক, যাতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করা যায়। এটা এমন একটি সময় ছিল, যখন বাদশাহ ফয়সাল নীরবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে পুনঃসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছিলেন। ১৯৭৩ সালে সেপ্টেম্বরে বাদশাহ ফয়সাল আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাাৎ করেন। ওই সাাতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি করেননি। বরং বাদশাহ ফয়সালকে তিনি বলেছিলেন, আপনি বাঙালি মুসলমানদের হজ ও উমরার সৌভাগ্য থেকে কেন বঞ্চিত করে রেখেছেন? বাংলাদেশী লেখক এম আর আখতার মুকুল নিজ চোখে দেখা শেখ মুজিবুর রহমান ও বাদশাহ ফয়সালের কথোপকথনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তার গ্রন্থে (গ্রন্থটির নাম মুজিবের রক্ত লাল-অনুবাদক) লিখেছেন, বাদশাহ ফয়সাল পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার ওপর গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, হারামাইন শরিফাইনের খাদেম হিসেবে তার কাছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাদশাহ ফয়সাল শেখ মুজিবকে বললেন, আপনি আপনার সংবিধানে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের পরিবর্তে পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ কেন লিখেছেন? শেখ মুজিব প্রত্যুত্তরে বললেন, মাননীয় বাদশাহ, আপনার দেশকে কিংডম অব সৌদি আরাবিয়া বলা হয়। ইসলামিক স্টেট অব সৌদি আরাবিয়া বলা হয় না। বাদশাহ ফয়সাল বললেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত হচ্ছে, সংবিধানে পিপলস রিপাবলিকের পরিবর্তে ইসলামিক রিপাবলিক লিখবেন। আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, ভারতে আটকে থাকা নব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর মুক্তির বিরোধিতা বন্ধ করবেন। প্রকাশ থাকে যে, প্রথম শর্তের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে ১৯৭২ সালে শিমলা চুক্তি স্বারিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দেয়া শুরু হয়েছিল না। ওই বন্দীদের মুক্তির জন্য বাদশাহ ফয়সাল শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া ইন্দিরা গান্ধির সাথেও আলোচনা করেন। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন তার গ্রন্থে লিখেছেন, বাদশাহ ফয়সাল চাচ্ছিলেন, ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানদের কনফারেন্সে শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করুক। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবের প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরী বাদশাহ ফয়সালের সাথে সাাৎ করেন। তিনি তার কাছে দাবি জানান, পাকিস্তানের প থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হলে শেখ মুজিব লাহোরে যাবেন। বাদশাহ ফয়সাল জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে কথা বলেন। আর এভাবেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। শেখ মুজিব লাহোর এলে তাকে জমকালো অভ্যর্থনা জানানো হয়। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে সৌদি আরব ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানদের কনফারেন্স পর্যন্তও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এর পরই পাকিস্তানি বন্দীদের মুক্তি দেয়া শুরু হয়। যখন সব পাকিস্তানি বন্দী মুক্ত হয়ে গেল, তখন বাদশাহ ফয়সাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। বাদশাহ ফয়সাল তার দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে কাছাকাছি আনতে সফল হন। তিনি গতানুগতিক আরব বাদশাহ ছিলেন না। বরং সাধনাপূর্ণ অন্তরের দরবেশ ছিলেন। আর এ জন্যই ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী তাকে গুলি করে শহীদ করে দেয়। কিছু দিন পরই বাংলাদেশে শেখ মুজিব এবং তার আরো কিছু দিন পরে

পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোকেও মেরে ফেলা হয়। এর পরই ইরাক-ইরানের যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া হয়। যে যুদ্ধ মুসলিম দেশগুলোকে বিভক্ত করে দেয় এবং মুসলমানদের মাঝে গোষ্ঠীগত উত্তেজনাও বাড়িয়ে দেয়।
পাকিস্তানের প্রতি বাদশাহ ফয়সালের ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ ভুট্টো ইসলামাবাদে ফয়সাল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। লায়ালপুরের নাম রাখেন ফয়সালাবাদ। করাচির ফয়সাল মহাসড়ক, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফয়সালবেস ও শাহ ফয়সাল কলোনি সর্বদা এক অকৃত্রিম ও পরম বন্ধুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ বাদশাহ ফয়সালের দেশ সৌদি আরব এক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানের কাছে সাহায্য চাচ্ছে। বিরোধের অপর প যদি মুসলমান না হতো, তাহলে পাকিস্তান তার অকৃত্রিম ও পরম বন্ধুকে অবশ্যই সহযোগিতা করত। আজ পাকিস্তানের জনমত ওই চিন্তাই করছে, যা বাদশাহ ফয়সালের চিন্তা ছিল। বাদশাহ ফয়সাল তার জীবদ্দশায় মুসলিম দেশগুলোর পরস্পর বিরোধে কারো প অবলম্বন না করে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা আদায় করেছেন। বাদশাহ ফয়সালের বেঁচে থাকাকালীন মিসর বারবার ইয়েমেনে অনুপ্রবেশ করে দণি ইয়েমেনকে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। বাদশাহ ফয়সাল মিসরের সাথে লড়াই থেকে দূরে থাকেন। বরং মিসরের এমন আচরণের পরেও তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যে মিসর একসময় ইয়েমেনে সৌদি আরববিরোধীদের সহযোগিতা করত, আজ সে সৌদি আরবের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মিসরের তুলনায় পাকিস্তানের কাছে সৌদি আরব সরকারের আশা-আকাক্সা বেশি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে শুধু এক পুরাতন ও অকৃত্রিম বন্ধুর স্বার্থ নয়, বরং নিজেদের ও সমগ্র মুসলিম বিশ্বের স্বার্থকে সামনে রাখা উচিত। আজ পাকিস্তানের জনমত সে কথাই বলছে, যা বাদশাহ ফয়সালের চিন্তা ছিল। 
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ও সরকারেরও সেই সাহসিকতা, তীè বুদ্ধি ও গাম্ভীর্যতার প্রয়োজন, যা বাদশাহ ফয়সালের বৈশিষ্ট্য ছিল। মধ্যস্থতাকারী অবশ্যই হতে হবে, তবে তার আগে মধ্যস্থতাকারীর গুণাবলি অর্জন করুন। 
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৯ এপ্রিল ২০১৫ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর 
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
ahmadimtiajdr@gmail.com

সুত্র: নয়াদিগন্ত, ২০ এপ্রিল ২০১৫,সোমবার

SUMMARY

2505-১.jpg