মীযানুল করীম
এবার চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের দৃশ্যত অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি নেপথ্যের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। ‘ভারতবান্ধব’ হিসেবে পরিচিত একটি সরকারের আমলে এই সফর যে ব্যাপক কভারেজ পেয়েছে মিডিয়ায়, এর কারণ বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে সফরটির বিরাট মূল্য ও মর্যাদা। চীনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিংয়ের দু’দিনের এই সফরের সময়ে দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির সংখ্যা এবং চীনের প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণের দিক দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে ক্ষমতাসীন মহল স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ অর্জন ও অবিস্মরণীয় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরেছে। বাস্তবতা হলো, আমাদের সরকার চীনের বিরাট অঙ্কের ঋণলাভ কিংবা চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের জন্য সাধ্যমতো প্রয়াস চালিয়েছে ঠিকই, তবে বেইজিংয়ের বিশেষ স্বার্থ ও বিপুল আগ্রহ না থাকলে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক এমন অভাবনীয় মাত্রায় উন্নীত হতে পারত না। ঢাকায় এখন ক্ষমতাসীন দলটি ‘ঐতিহ্যগতভাবে’ ভারতমুখী (অনেকের মতে ভারতনির্ভর) হিসেবে অভিহিত। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে তারা সমালোচিতও হয়েছেন। অপর দিকে, গত বছর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় সফরে এসে যতটা সাড়া ফেলেছিলেন, এবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আগমনে সাড়া পড়েছে এর চেয়ে অনেক বেশি। মিডিয়া কভারেজের দিক দিয়েও ভারতের চেয়ে চীন এগিয়ে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতের অতি ঘনিষ্ঠ এবং দিল্লির জোরালো পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট একটি সরকারের সময়েই এই দুটো রাষ্ট্রীয় সফর সম্পন্ন হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বরাবরই আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল গণচীনের দিকে। তিনি কখনো ‘চীনপন্থী’ রাজনীতি করেননি। বরং এ দেশে যারা ‘চীনপন্থী’ হিসেবে অভিহিত ও পরিচিত, তারা পাকিস্তান আমল থেকেই তার ও আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বাংলাদেশ আমলে এই বিরোধিতা চরমে ওঠে। সেই প্রো-পিকিং কমরেডদের কেউ কেউ মুজিবকন্যার সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন, এমনকি এখনো আছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তদানীন্তন প্রেক্ষাপটে মুজিব সরকারের সাথে চীনপন্থী রাজনৈতিক মহলের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ‘সাপে-নেউলে’। চীনের মাওবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রতি অনুরক্ত দলগুলোর একাংশ তখন প্রকাশ্যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে তৎপর ছিল। আরেক অংশ অপ্রকাশ্য ও সশস্ত্র তৎপরতা অব্যাহত রাখে। তবে ‘চীনপন্থী’ হিসেবে পরিগণিত সবার বিরুদ্ধে তদানীন্তন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের একই জোটভুক্ত রুশপন্থী ন্যাপ ও সিপিবির অভিযোগ ছিল, এরা অতি বামপন্থী ও মাওবাদী।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, মুজিব আমলে চীনপন্থী কয়েকটি সংগঠনের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মোকাবেলা করা হচ্ছিল পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী দিয়ে। অপর দিকে, তাদের কোনো কোনো শীর্ষ নেতার সাথে বঙ্গবন্ধু অতীত রাজনীতির যোগসূত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এই বাম নেতাদের কেউ কেউ ভাষা আন্দোলনে এবং পঞ্চাশ ও ষাট দশকে বিরোধী দলের আন্দোলনে অবদান রেখেছেন।
এর পাশাপাশি শেখ মুজিব চীনের সাথে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন যথাসময়েই। অথচ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে অত্যধিক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে চীনের তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার এবং এর শীর্ষ নেতাদের সাধারণত চিত্রিত করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে। এটা সত্য যে, প্রথম দিকে গণচীন বাংলাদেশের জাতিসঙ্ঘে অন্তর্ভুক্তিও সমর্থন করেনি। চীন সরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের আগে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিও দেয়নি। তবে এর আগে মুজিব আমলেই চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল। বিশেষ করে পাট রফতানির জন্য এর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে নতুন চীন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ একটি বহুলালোচিত ও তথ্যবহুল গ্রন্থ। এতে মুজিব তার শৈশব থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর ‘মুসলিম’ বর্জন পর্যন্ত তিন দশকের বহু ঘটনা তুলে ধরেছেন; সমাজ ও রাজনীতির অনেক তথ্য দিয়েছেন অকপটে ও আন্তরিকভাবে। বইটিতে আছে তার চীন সফরের অভিজ্ঞতার বয়ানও। চীন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন এতে ফুটে উঠেছে, যার প্রভাব বজায় ছিল সারা জীবন।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২২১ থেকে ২৩৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত চীন যাত্রা, সেখানে শান্তি সম্মেলনে যোগদান, বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ আছে। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তদানীন্তন পিকিং (আজকের বেইজিং) নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘শান্তি সম্মেলন’। এতে তৎকালীন পাকিস্তানের ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র পাঁচজন আমন্ত্রিত হন। তারা হলেন আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং উর্দু লেখক ইউসুফ হাসান। যাওয়া-আসার প্লেন টিকিট দিয়েছিলেন সম্মেলনে উদ্যোক্তারা। ঢাকা থেকে যে প্লেনে তারা হংকং হয়ে চীন গিয়েছিলেন, সেটাতে মাহমুদ আলী কাসুরীসহ (পশ্চিম) পাকিস্তানের কয়েকজন প্রতিনিধিও ছিলেন। হংকং পৌঁছে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। নেতা হলেন পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়া) মানকী শরিফের পীর সাহেব আমিনুল হাসনাত। হংকং থেকে শেখ মুজিবসহ সবাই ট্রেনে ক্যান্টন পৌঁছেন।
চীনে প্রবেশ করার পরই তরুণ মুজিবের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা লিখেছেন এ ভাষায়Ñ ‘আফিম খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিম এখন আর কেউ খায় না, আর ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হলো এ এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নেই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই আজ জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত বড় আলোড়ন সৃষ্টি এরা কী করে করল।’
ক্যান্টন থেকে প্লেনে দেড় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সবাই পৌঁছলেন রাজধানী পিকিংয়ে। মুজিবের ভাষায়, ‘সে দেশের সৌন্দর্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।... নয়া চীন মনপ্রাণ দিয়ে নতুন করে গড়তে শুরু করেছে।’ পিকিং দেখে তিনি লিখেছেন, ‘এখন সমস্ত শহর যেন নতুন রূপ ধরেছে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণভরে হাসছে।’
পিকিং নগরীর সবচেয়ে বড় হোটেলে এই প্রতিনিধিদলের থাকার ব্যবস্থা হয়। তবে দলনেতা হিসেবে পীর সাহেব বলে দিয়েছেন কোনো মুসলিম হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। এ জন্য দুই মাইল দূরে যেতে হয়েছিল রাতে ভীষণ শীতের মধ্যে বাসে চড়ে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল রেজা হোটেলে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। বললেন, আমাদের কোনো অসুবিধা হলে বা কোনো কিছুর দরকার হলে তাকে যেন খবর দেই। তিনি আমাদের খাবার দাওয়াতও দিয়েছিলেন।’ এই রাষ্ট্রদূত শেখ মুজিবসহ প্রতিনিধিদের কাছে চীনের প্রশংসনীয় ভাবমূর্তি তুলে ধরেছিলেন। মুজিব তার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘কালোবাজার বন্ধ; জনগণ কাজ পাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। কঠোর হাতে নতুন সরকার এইসব দমন করেছে। যে কোনো জিনিস কিনতে যান, একদাম। ... রিকশায় চড়েছি। চীনা টাকা যাকে বলে ইয়েন, হাতে করে বলেছি, ‘ভাড়া নিয়ে যাও কত নিবা।’ যা ভাড়া তাই নিয়েছে, একটুও বেশি নেয় নাই।’
চীনের জনজীবনের মতো ওই শান্তি সম্মেলনের পরিবেশও প্রভাব ফেলেছিল মুজিবের মনে। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মাও সে তুং, চৌ এন লাই, মাদাম সান ইয়াৎ সেন, লিও শাও চি, চু তে প্রমুখ নেতা। সম্মেলন পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সশস্ত্র বাহিনী ভূমিতে ও আকাশে মহড়া দেখাল। মুজিব বিস্মিত হয়ে দেখলেন, ‘এত বড় শোভাযাত্রা; কিন্তু শৃঙ্খলা ঠিকই রেখেছে। পাঁচ-সাত লক্ষ লোক হবে মনে হয়।’ শান্তি সম্মেলনে ৩৭ দেশের ৩৭৮ জন প্রতিনিধি ছিলেন। মুজিব যে, পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে গেছেন, তা উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিব বক্তব্য দিলেন। মুজিব বক্তৃতা দিলেন বাংলায়। কারণ, ‘আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ শান্তি সম্মেলনের পর বিরাট জনসভা হয়েছিল। এতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আলাদা আলাদা মিছিল করে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে একটি মসজিদে গিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্মৃতিচারণে কাশ্মির প্রসঙ্গও এসেছে। তিনি লিখেছেন ওই সম্মেলন প্রসঙ্গে, ‘ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মির নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পর একটা যুক্তবিবৃতি দেয়া হয়েছিল। তাতে ভারতের প্রতিনিধিরা স্বীকার করেছিলেন, গণভোটের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মির সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। এতে কাশ্মির সমস্যা সমস্ত প্রতিনিধিদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছিলাম।’
ওই সম্মেলনে মুজিবের মোলাকাত হয়েছিল বিখ্যাত রুশ লেখক আসিমভ, তুরস্কের নির্বাসিত কবি নাজিম হিকমত, ভারতের ড. সাইফুদ্দীন কিচলু, চীনের মাদাম সান ইয়াৎ সেন প্রমুখের সাথে।
১৯৫২ সালের সে সময়টা ছিল ‘হিন্দি-চীনী ভাই ভাই’য়ের জমানা। পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। মুজিব চেয়েছিলেন, এ অবস্থার পরিবর্তন হোক। তিনি লিখেছেন, ‘একটা জিনিস অনুভব করেছিলামÑ চীনের সরকার ও জনগণ ভারতবর্ষ বলতে পাগল। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব করতে তারা আগ্রহশীল; তবে ভারত তাদের বন্ধু, ‘তাদের সব কিছুই ভালো।’ আমরাও আমাদের আলোচনার মাধ্যমে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পাকিস্তানের জনগণ চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহীশীল।’
সম্মেলনের পর শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রতিনিধিরা তিয়েন শিং বন্দরে বেড়াতে যান। সেখানে ভোজ অনুষ্ঠানে একজন ইমাম সাহেবসহ কয়েকজন মুসলমান ছিলেন। তারা জানান, ‘ধর্ম পালনে বাধা না থাকলেও ধর্ম প্রচার করা যায় না।’ এরপর প্রতিনিধিদল চীনের সাবেক রাজধানী নানকিং, সাংহাই, হ্যাংচো, ক্যান্টন সফর করে। সাংহাইতে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন শ্রমিক কলোনি দেখার জন্য। সেখানে এক শ্রমিকের নববধূকে নিজের আংটি খুলে তা দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। সৌন্দর্যের কারণে হ্যাংচোকে বলা হয়, ‘চীনের কাশ্মির।’ সেখানে মুজিব মনের আনন্দে লেকে নৌকা বাইতে শুরু করে দেন।
চীন সফরের বিবরণের উপসংহারে শেখ মুজিবুর রহমান পুঁজিবাদের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি জানিয়ে দেন চীন সম্পর্কে তার ধারণা, ‘আমার মনে হলো, কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সব কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই।’
সাংবাদিকের বইতে যা আছে
এ এল খতিব দীর্ঘ দিন ঢাকায় থেকে সাংবাদিকতা করেছেন। ভারতের মহারাষ্ট্রের এই মানুষটি অবাঙালি হয়েও এ দেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে ছিলেন একাত্ম। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরক্ত। দু’দশক ঢাকায় কাটিয়ে ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লি গমন করেন। সেখানেই ১৯৮৪ সালে তার মৃত্যু হয়। খতিবের একটি আলোচিত গ্রন্থ Who killed Mujib (কে মুজিবকে হত্যা করেছিল)? এতে ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি ও খন্দকার মোশতাক প্রসঙ্গ ছাড়াও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক পটভূমি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ব্যাপারে তিনি আলোকপাত করেছেন। বইটিতে বহু অজানা তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। এতে আছে চীন সম্পর্কে মুজিবের ও তার সরকারের মনোভাবের বিষয়ও।
এ এল খতিব তার বইতে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে। তিনি একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান। ... চীনের বিষয়ে মত দেয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান তখনো খুব সতর্ক ছিলেন। খুব মৃদু ভাষাতেও চীনের কোনো সমালোচনা করা হয়নি; এমনকি চীন যে, বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বর্বরতা সমর্থন করেছিল, সে জন্য কোনো বেদনা বা ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়নি।’
খতিবের বইটিতে এরপর লেখা হয়েছে, ‘আমি আশা করবো’, শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীনÑ যে দেশটি নিজেরাই যুদ্ধবাজ এবং সামন্ত ও ঔপনিবেশিক শোষকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছেÑ তারা বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় সংগ্রামের এই বীরোচিত সাফল্যকে স্বীকৃতি দিবে।’
স্মর্তব্য, চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা সেই ষাটের দশকের আইয়ুবী শাসনামল থেকেই। উভয় দেশই ভারতের প্রতিপক্ষ। অনেক ভাষ্যকারের মতে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল চীনের প্রতি একটা আঘাততুল্য। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে চীনের প্রতিপক্ষ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মিত্রদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অবতীর্ণ হয়েছিল। ফলে চীন মনে করত, এই যুদ্ধ ‘সোভিয়েত সহায়তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসন।’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে, বিুব্ধ চীন বিদ্রƒপ করে বলেছিল, ‘আরেকটি দেশ ভেঙে দিতে পেরে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছে।’ ৭১-এর ২৩ ডিসেম্বর ভুট্টোকে পাঠানো টেলিগ্রামে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ‘বিদেশী আগ্রাসন ঠেকাতে’ পাকিস্তানকে সহযোগিতার ব্যাপারে চীনের প্রতিশ্রুতি পুনরায় প্রকাশ করেছিলেন।
এসব কিছু নিশ্চয়ই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অজানা ছিল না। কিন্তু কিছু ‘চীনপন্থী’র উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়েও তিনি চীন সরকার সম্পর্কে মন্তব্যের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতেন। এর কারণ ছিল, তিনি পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ দু-এক দেশের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব দেশের সাথেই সুসম্পর্ক রাখার ভারসাম্যপূর্ণ নীতির পক্ষপাতী ছিলেন। সেই তরুণ বয়সে চীনের বিপ্লব ও জাগরণ, উন্নয়ন ও সংস্কৃতি তার মনে যে ছাপ ফেলেছিল, তার রেশ কখনো মুছে যায়নি। আর সর্বাধিক জনবহুল বৃহৎ রাষ্ট্রটি যে, একদিন বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতির অঙ্গনে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, এটাও মুজিব সে দিন ধারণা করতে পেরেছিলেন।
যা হোক, আমরা আবার সাংবাদিক এ এল খতিবের বইতে ফিরে যাই। তিনি লিখেছেন, ‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২ শেখ মুজিব যখন ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২ যখন আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন, তার কোনোটিতেই ঢাকাস্থ চীনা কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন না। তারা ২৪ জানুয়ারি রেঙ্গুন হয়ে দেশে ফিরে যান। এর পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ আশাবাদী ছিলেন যে, চীন খুব শিগগিরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিবে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ আজাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের মনে হচ্ছেÑ যেকোনো মুহূর্তে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। চীনের জনগণের প্রতি রয়েছে আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা। আমরা চীনের নেতাদের প্রশংসা করি এবং আমরা তাদের বিপ্লবকেও সমর্থন করেছি।’ আবদুস সামাদ আজাদ স্মরণ করিয়ে দেন, আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে ঢাকায় রাষ্ট্র্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান চীনে সরকারি একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ও একটি সফরকারী দলের ছিলেন সদস্য। সামাদ নিজেও চীন সফরে গিয়েছিলেন।
এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন, বাংলাদেশের প্রথম সরকার শুরু থেকেই চীনের স্বীকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে এ জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। তবে চীন মুজিব আমলে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি যদিও সে আমলেই দু’দেশের মাঝে বাণিজ্যিক যোগাযোগের কথাবার্তা হয়েছিল। চীন ১৫ আগস্টের পরপর স্বীকৃতি দিয়েছিল, যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় খন্দকার মোশতাক আসীন। এ এল খতিব এ প্রসঙ্গে কৌতূহল-উদ্দীপক তথ্য দিয়ে বলেছেন, ‘(মার্কিন প্রেসিডেন্ট) নিক্সনের চীন সফরের সময় মওলানা ভাসানী চেয়ারম্যান মাও সেতুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এর অল্প সময় পরই খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি নিয়ে চীন সফর করেছিলেন।’ এখানে ১৫ আগস্টের আগের আমলের কথা যে বলা হচ্ছে, তা স্পষ্ট। অর্থাৎ, মুজিব সরকারের প্রতিনিধিরূপে এবং সরকার প্রধানের একান্ত আগ্রহেই মোশতাককে তখন চীনে পাঠানো হয়েছিল।
এ এল খতিব চীনের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য বেইজিং সরকারের তীব্র সমালোচনা করতেন। তিনি লিখেছেন, ‘জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঠেকানোর জন্য চীন ২১ আগস্ট ১৯৭২-এ প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো দেয়ার ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল।’ আরো লিখেছেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ চীনের এই ভূমিকাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে তিনি ছিলেন চীনকে ‘অসন্তুষ্ট’ না করার জন্য উদগ্রীব।’ খতিবের ভাষায়, সামাদ আজাদ বলেছিলেনÑ ‘বাংলাদেশ এর পরও চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রাখবে।’
সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি নয় বৈরিতা
এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয়, চীন তখনো বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বরাবরই চীনের স্বীকৃতির প্রত্যাশী ছিল। এর মূল কারণ, তার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বৈরিতা নয়’। কমিউনিস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে মুজিব পরিবারের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর। এ কারণে পরবর্তী অন্তত দু’দশক আওয়ামী মহল সে ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে হলেও চীনকে অভিযুক্ত করত আরো কয়েকটি রাষ্ট্রের সাথে।
‘ঘোরতর চীনবিরোধী’ হিসেবে নিকট অতীতে পরিচিত সেই দল, আওয়ামী লীগের আমলে গত কয়েক বছরে চীনের সাথে শুধু অর্থনৈতিক নয়, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের সম্পর্ক ক্রমেই জোরদার হয়েছে। এই ধারাবাহিকতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হলো, এবারে চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন এবং তার বিপুল সংবর্ধনার পর বাংলাদেশের জন্য চীনের প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ এবং সম্পাদিত চুক্তি উভয় ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ম্লান হয়ে যাওয়া।
আসলে, পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আর বিদ্যমান বিশ্ববাস্তবতায় এটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণের কারণে হোক আর চীনের চোখে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে হোক, এটা চূড়ান্ত সত্য যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের ‘স্থায়ী মিত্র’ নেই, যা আছে তা হলো স্থায়ী-জাতীয় স্বার্থ।
সুত্র: নয়াদিগন্ত, ২৩ অক্টোবর ২০১৬,রবিবার