সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ খালেদ
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। অস্থায়ী ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সরকারের কর্মকর্তারা যে দিন ঢাকা এলেন, তাদের দেখতে এয়ারপোর্টে (পুরনো বিমানবন্দরে) গেলাম। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর কালো ‘মুজিব কোট’ পরিহিত প্রত্যেকের কাঁধে ক্রিম কালারের কালোপেড়ে পশমি শাল। একে একে প্লেন থেকে নেমে তারা গাড়িতে উঠে ঢাকা শহরের দিকে চলে এলেন। বহু মানুষ সে দিন বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিল। বাঙালির বুকভরা আশা জাগিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তখন তারা প্রতীক্ষায় ছিলেন কবে তাদের নেতা ‘শেখ সাহেব’ দেশে ফিরবেন।
পাকিস্তানে ৯ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সোজা লন্ডন চলে যান। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তিনি দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে ঢাকা আগমন করেন। সকাল থেকে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। রাজপথ লোকে লোকারণ্য। ঢাকার নারী-পুরুষ তথা আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক লোক এসেছেন। শেখ মুজিব আসছেন। তাকে একনজর দেখবেন তারা। সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে। কখন নেতাকে বহনকারী প্লেনটি দেখা যাবে। বহু কষ্টে জনতার কয়েকটি স্তর ডিঙিয়ে ঢাকা ক্লাবের সামনের রাস্তার দক্ষিণ পাশের সামনের সারিতে একটু জায়গা পেয়েছিলাম। যারা রাস্তায় ঠাঁই পেলেন না তারা আগে থেকেই রেসকোর্স ময়দানে সমবেত। সে বিশাল মাঠও লোকে লোকারণ্য। শেখ মুজিব সেখানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। দুপুর গড়িয়ে গেছে। অনেক প্রতীক্ষার পর ব্রিটিশ প্লেনটি ঢাকার আকাশে দেখা গেল। জনতা গর্জে উঠল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে।
এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে অবতরণের পর জনাকীর্ণ দীর্ঘ রাজপথ পেরিয়ে ঢাকা ক্লাবের সামনের রাস্তায় অনাড়ম্বর খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে দিয়ে নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত শেখ মুজিবুর রহমান যখন রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছেন, তখন নিজের অজান্তেই সবার সাথে গর্জে উঠলাম- ‘জয় বাংলা’। আসলে স্লেøাগান দেয়া আমার ধাতে নেই। জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করিনি। তাই স্লোগান দেয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। যা হোক, শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছে থেকে দেখলাম। এর আগে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলের পার্লামেন্টারি পার্টির সমাবেশে দোতলার ব্যালকনিতে বসে দূর থেকে তাকে প্রথম দেখেছিলাম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তাকে কাছে থেকে দেখেছি। আজ মনে হলো, জীবন বাজি রাখা এবং জবরদস্তিমূলক কারাভোগে শেখ মুজিবুর রহমান যেন বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ডান হাতে কালো ফ্রেমের চশমাটি ধরে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ছেন; তিনি ক্লান্ত।
রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবের উত্থান পাকিস্তানের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণকারী প্রবল প্রতাপশালী নবাব, জমিদার, শিল্পপতি আর সেনাবাহিনীর প্রবল প্রতাপান্বিত বাঘা বাঘা জেনারেলদের সাথে পাল্লা দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ একটি জেলা ফরিদপুরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পাকিস্তানের দারিদ্র্যক্লিষ্ট একটি প্রদেশের জনগণকে সাংগঠনিক প্রতিভার দীপ্তিতে আলোকিত করে, অচিন্তনীয় জাদুবলে স্বতন্ত্র স্বাধীন একটি দেশের দ্বারপ্রান্তে এনে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। এটা মোটেও সহজ কথা নয়। আজ তিনি তার রাজনৈতিক সংগ্রামে বিজয়ের শীর্ষে আরোহণ করলেন। ক’জনার ভাগ্যে এমনটি ঘটে। একজন রাজনীতিকের জীবনে এটা এক পরম পাওয়া।
রেসকোর্স মাঠে মুজিব কী বলেন তা শোনার বড় আগ্রহ সবার। দেখলাম রেসকোর্সে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। দুর্ভেদ্য ভিড়। রাস্তার সারিবদ্ধ জনতাও সে দিকে ছুটছে। কাছেই পরীবাগে নিজের বাসা; কিন্তু টেলিভিশন নেই। তাড়াতাড়ি ওযারীর র্যাংকিন স্ট্রিটে শ্বশুরের বাসায় চলে গেলাম। ভাবলাম রেসকোর্সে যখন দেখাই যাবে না তখন টেলিভিশনেই দেখি। রিকশায় করে সেখানে পৌঁছে দেখি তার ভাষণ শুরু হয়ে গেছে। তদানীন্তন অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করছেন। বাসার নারী-পুরুষ প্রায় সবাই শুনছেন। একপর্যায়ে আমার পেছনে টেলিভিশন দর্শকসারি থেকে এক ভদ্রমহিলার বিষন্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- ‘ভাঙো বন্ধু’। পাকিস্তান ‘ভেঙে গেল’, সম্ভবত এ কারণেই তার ব্যতিক্রমী খেদোক্তি।
কিন্তু আক্ষেপ করে কী হবে? জগতে চলছে নিয়ত ভাঙা-গড়ার খেলা। ভারতবর্ষ এক দেশ ছিল। কত সংঘাতের ভেতর দিয়ে ভেঙে গেল। পাকিস্তানও সে পরিণত বরণ করেছে। এই তো সে দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল, ভেঙে গেল যুগোস্লাভিয়া। মোট কথা পৃথিবীর মানচিত্র নিয়ত পরিবর্তনশীল। সবাইকে তা মানতেই হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফির একটি গানের কথা ‘বিগড়েগি আয়োর বনেগি/দুনিয়া এয়েহি রহেগি/হোঙ্গে এয়েহি ঝামেলে/ইয়ে জিন্দেগিকে মেলে/ দুনিয়ামে কম না হোঙ্গে/ আফসোস হাম না হোঙ্গে।’ জীবন ও পৃথিবীর প্রতি এটাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এটাই অনস্বীকার্য, ঐতিহাসিক ও শাশ্বত সত্য।
১০ জানুয়ারি ভাষণ শুনছি। শেখ মুজিবুর রহমান আবেগাপ্লুত। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুমালে চোখ মুছতে মুছতে অনেক কথার মধ্যে বললেন, “রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে- মানুষ করোনি।’ রবীন্দ্রনাথ সত্য বলেননি। দেখে যাও, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।” তিনি আরো বললেন- ‘আমি বলেছিলাম : আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। একবার মরি, দুইবার মরি না। আমাকে যদি তোমরা মেরে ফেল, আমার লাশটা আমার বাঙালির হাতে ফিরিয়ে দিও।’
তিনি আরো বললেন- ‘জেলে আমার পাইপের জন্য এ্যারিনমোর তামাক দেয়া হতো।’ পশ্চিম দিকে শূন্যে ডান হাতের তর্জনী আন্দোলিত করে বললেন, ‘ভুট্টো সাহেব, সুখে থাকো।’ এরপর বিশাল জনতাকে শুধালেন, ‘মুসলমানরা বুঝি রেপ করে?’ এ বক্তৃতার কিছু দিন পর কলকাতার ‘দেশ’ সাপ্তাহিকীর একটি প্রচ্ছদ কার্টুন চিত্রে দেখা গেল, দণ্ডায়মান রবীন্দ্রনাথ অবনতমস্তকে মুজিবকে বলছেন- ‘ভুল বলেছিলুম। শুধরে দিলে।’ বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি মুসলমানের নবজন্মের নায়ক।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, ১৩ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের তাদের নিজ দেশ ভারতে ফেরত পাঠানো। এ দুঃসাধ্য সাধন করা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি তার এ দায়িত্ব পালন করতে দ্বিধা করেননি কিংবা সময় নেননি। সে সময় আমাদের মনে এই প্রতীতি জন্মেছিল যে, সমসাময়িক বিশ্বে মাত্র দু’জন নেতা নিজ দেশে নিরঙ্কুশ জনসমর্থন লাভ করছেন। একজন চীনের মাও সে তুং, আরেকজন বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান। তারা বিশ্বের যেকোনো দুর্বৃত্তের কাছে আতঙ্ক। কেননা, নিজ দেশের জনগণ তাদের দু’জনেরই হাতের মুঠোয়। শেখ মুজিব এটা বুঝতে ভুল করেননি। এ শক্তি তিনি যথাশিগগির সম্ভব কাজে লাগিয়েছিলেন বলেই ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর শেষ দলটির বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে।
কিন্তু বেদনাদায়ক এই যে, সে দিন শেখ মুজিবকে যেমন দেখেছি এবং জনসমাগম যা হয়েছিল দেখেছি, তাতে এত বড় মাপের একজন নেতার অবদানকে অনেক ক্ষেত্রে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে দেখেছি। বস্তুত তিনি বিশ্বের সব দেশের মুসলমানের সাথে একাত্ম হয়ে পথ চলবেন বলেই ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোর গিয়েছিলেন। সেখানে ভুট্টোকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন; কিন্তু আজ মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হয়েও মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের প্রভাব নিষ্প্রভ কেন? অধিকন্তু যে গণতন্ত্রের জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, সেই গণতন্ত্রের লাশ সে আমলেই কফিনবন্দী হতে দেখেছি।
বিস্ময়কর হলো, তিনি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোরে সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার পর বিরূপ দেখা যায়নি। কর্মচঞ্চল শহরে লোক চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সকালে পরীবাগের বাসা থেকে বাসে করে কর্মস্থল তিতুমীর কলেজে যাওয়ার পথে কিছুই টের পাইনি। স্বাভাবিকভাবে কলেজের কাজকর্ম চলছিল।
যিনি নন্দিত হয়েছিলেন একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় একক জাতীয় বীর হিসেবে, তিনি আজ যেন খণ্ডিত এবং তার ভাবমর্যাদা শুধু একটি দলের কাণ্ডারী পর্যায়ে। তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত তার অবদানকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিন যার ডাকে দেশবাসী এক হয়েছিল, পরে নিজ দলীয় কিছু লোকের ভুলে তাদের কাছেই তিনি হয়ে গেলেন ‘বিতর্কিত’।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার
সুত্র: নয়াদিগন্ত, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯