ফয়েজ রেজা
শিল্পী কামরুল ইসলামের আঁকা স্কেচে এরশাদ ছিলেন ‘বিশ্ববেহায়া’। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্লোগানে এবং সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে তিনি ছিলেন ‘স্বৈরাচার’। রাজনীতির চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশে সেই এরশাদ এখন ‘বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ’! সাবেক ‘সফল’ রাষ্ট্রপতি! মৃত্যুকালে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও তার নিজ এলাকায় এবং সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে চিরনিদ্রায় শায়িত। সাবেক সেনাপ্রধান হিসেবে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘গার্ড অব অনার’।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘গার্ড অব অনার’ বা রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে খুব কম রাষ্ট্রপ্রধানের। অবশ্য এরশাদের মতো এতো সমালোচিত রাজনীতিবিদের সংখ্যাও কম। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণায় মনে হয়, বর্তমান বাংলাদেশে এরশাদের অনুসারীর সংখ্যাই বেশি। কেউ কেউ তো এও বলছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবাই এরশাদ।’ এটিও ঠিক, খন্দকার মোশতাক বাদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধান মৃত্যুর পর লোকমুখে এরশাদের মতো এত অসম্মানিত হননি।
জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর মুজিব সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। মোশতাক বঙ্গবন্ধুর অন্ধ অনুসারী বলে পরিচিত। সেদিন বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবরটি খুব ছোট ঘটনা হিসেবেই জায়গা পেয়েছিল খবরের কাগজে। ‘শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে নিহত হন বলে জানানো হয়।’ (সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫)
এতটুকুই ঘটনা! এরপর ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে এবং পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে দাফন করা হয়’—একজন সহকারীর বরাত দিয়ে এমন খবর প্রকাশ করেছিল বাসস। শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ দাফনের সময় যে ‘পূর্ণ মর্যাদা’ দেওয়া হয়েছিল, তার নমুনার কথা লিখেছেন লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ, পিএসসি। ১৯৭৫ সালে যিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং ঢাকার স্টেশন কমান্ডার হিসেবে ১৫ আগস্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দুর্বিষহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং দাফন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের লাশও তার তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়েছিল বনানী কবরস্থানে।
১৫ আগস্ট, রাত ৩টায় তিনি নির্দেশ পেয়েছিলেন—রাত পোহাবার আগেই যেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির লাশগুলো বনানী কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয়বার নির্দেশনা দেওয়া হলো—শেখ মণি ও সেরনিয়াবাতের বাড়িতে যেসব লাশ আছে, সেগুলোও বনানীতে দাফন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর লাশ কোথায় দাফন করা হবে, এটা প্রথমে বলা হয়নি। পরে জানানো হয়েছিল তাঁর লাশ দাফন করা হবে গোপালগঞ্জে তাঁর বাবা মা’র কবরের পাশে। তিনি লিখেছেন—‘রাতেই আবার ৩২ নম্বরে গেলাম। মেজর হুদা সৈনিকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে কর্কশ কণ্ঠে গালিগালাজ করছে। সৈনিকরা সুযোগ পেলেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে।
তার আগেই প্রতিটি লাশ কফিনে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর লাশ বনানীতে দাফন করা হবে না, তাই বঙ্গবন্ধুর লাশ চিহ্নিত করা হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। একজন সুবেদার বললো—হ্যাঁ।
কফিনের মুখ খুলে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালতেই দেখলাম এটা বঙ্গবন্ধুর লাশ নয়। ওই সুবেদারকে ধমক দিলাম। আসলে ওটা ছিল শেখ নাসেরের লাশ। দেখতে অনেকটা বঙ্গবন্ধুর মতো।
লাশ খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেলো ট্রাকের পেছনে একটি কফিনে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। পরে নিজ হাতে কফিনের গায়ে পরিচিত লাশের নাম লিখলাম।...বঙ্গভবন থেকে নির্দেশ পেলাম বঙ্গবন্ধুর ডেডবডি বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার ব্যবহার করব। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
এয়ারফোর্স অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শমসেরকে দায়িত্ব দেওয়া হলো হেলিকপ্টারে করে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হলো টুঙ্গিপাড়া। আগেই টুঙ্গিপাড়ায় কড়া পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন টুঙ্গিপাড়ায় নামানো হলো, সেনাবাহিনীর লোকজনকে যখন এলাকার লোকজন দেখল, তখন সবাই ভয়ে পালিয়ে গেলো। অনেক কষ্টে ১৮-১৯ জন লোক এনে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন করা হলো। স্থানীয় একজন মাওলানা এর আগে বঙ্গন্ধুকে গোসল দিয়েছিলেন।
যে ব্যক্তি সারা জীবন বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তার জন্য সংগ্রাম করে গেলেন, সেই অকুতোভয় নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে শেষ বিদায় জানানো হলো অতি নীরবে, সুদূর টুঙ্গিপাড়ার একটি গ্রামে।’ (সূত্র: জাতীয় শোক দিবস বিশেষ সংখ্যা, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৫ আগস্ট ১৯৯৬)
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির এমন অমর্যাদাপূর্ণ দাফনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছিলেন খন্দকার মোশতাক। সেদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল—‘জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। প্রাজ্ঞ জননায়ক খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দখল করেছেন দেশপ্রেমিক সশস্ত্র সেনাবাহিনী বাহিনী।’ (সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৬ আগস্ট ১৯৭৫)
এদিন পত্রিকায় বড় করে প্রকাশ করা হয়েছিল খন্দকার মোশতাকের আত্মজীবনী। ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল (১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শুক্রবার) সকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনভার গ্রহণ করেছেন’—এমন খবর পরিবেশন করেছিল বাসস।
মোশতাক ক্ষমতায় আসার পর দেশে সামরিক আইন জারি করে। বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আবু হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ মোশতাকবিরোধী হিসেবে বিবেচিত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়।
সরকারবিরোধী তৎপরতার দায়ে পূর্বে গ্রেফতার হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাদের মৃত্যুর বিষয়টি অত্যন্ত মূল্যহীন ও একটি অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল সরকারের কাছে। জেলের ভেতরে এমন নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল। হরতালের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি মৌন মিছিল বের হয়েছিল, মিছিলে শেখ মুজিবুর রহমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। আর সরকারি বার্তায় বলা হয়েছিল—‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সম্প্রতি চারজন প্রখ্যাত নেতার হত্যার প্রতিবাদে কোনও একটি গ্রুপ অর্ধদিবস যে হরতাল ডেকেছে, তার প্রতি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ওই ঘটনা আশু তদন্ত করার জন্য তিন জন বিচারপতির সমন্বয়ে ইতোমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে, সুতরাং এ ব্যাপারে হরতাল পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে বলে সরকার মনে করে না।’ খুনিরা মোশতাকের ছত্রছায়ায় দেশ ত্যাগ করে ব্যাংকক হয়ে উত্তর আফ্রিকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান পদে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে তার সহকারী নিযুক্ত করা হয়। তখন থেকেই দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশেষত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামরিক বাহিনীর হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে।
অভ্যুত্থানের সময় ৫৫ হাজার সদস্যের সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। পাকিস্তান প্রত্যাগতদের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার। তার মধ্যে অফিসার ছিলেন ১১০০ জন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীর। জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত।
জেল হত্যা ঘটনার পর ‘খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে গ্রেফতার করেছিলেন। কিন্তু তিনি সরকারবিরোধী গণ অসন্তোষকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তার কাজকর্মে দৃঢ়তার অভাব পরিলক্ষিত হয়, এজন্য তাকে প্রাণ হারাতে হয়।’ (সূত্র: বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা ১৯৭১-১৯৮৫, লেখক:ভ্লাদিমির পুচকভ, পৃষ্ঠা: ৯৮)
খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর। ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে। রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যিনি ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ।
রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার বাসভবনে, ১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই। বার্ধক্যজনিত রোগে তার মৃত্যু হয়েছিল। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তার মৃত্যুর পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে সেন্ট স্টিফেন হাসপাতালে মারা যান। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে তার লাশ দাফন করা হয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও মন্ত্রিপরিষদ তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছিল। ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৯৯ সালের ১১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তার মৃত্যু সংবাদ গুরুত্ব পায়নি খবরের কাগজে।
৩০ মে ১৯৮১ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবদুস সাত্তার। ১৯৮৫ সালের ৫ অক্টোবর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হৃদরোগের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সামরিক মর্যাদায় তার দাফন হয়েছিল। শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ এবং রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছিলেন।
প্রাজ্ঞ জননায়ক! মোশতাক বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে মৃত্যুকে বলা যায় স্বাভাবিক মৃত্যু। তারপরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের চিত্রে মোশতাক যেদিন মৃত্যুবরণ করলেন, সেদিন দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদটি ছিল এমন—‘সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল (মঙ্গলবার) অপরাহ্ণে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে অবস্থিত মনোয়ারা হাসপাতালে ইন্তেকাল করিয়াছেন।’ খন্দকার মোশতাকের মৃত্যু হয়েছিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে।
মৃত্যুর পরদিন বিকাল ৫টায় দাউদকান্দিতে খন্দকার মোশতাক আহমদের দশপাড়া নাসির ময়দানে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। তার একমাত্র পুত্র খন্দকার ইশতিয়াক আমহদসহ পরিবারের স্বজনরা সেদিন জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন বাদ জোহর বায়তুল মোকারম মসজিদে তার জানাজা হওয়ার কথা ছিল। পরে তা বাতিল করা হয়। বিরোধী দলের সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করে পুলিশ কর্তৃপক্ষ মোশতাকের লাশ বায়তুল মোকাররম মসজিদে না আনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ফলে তার লাশ প্রথমে বারডেমে রাখা হয়েছিল। পরে পাঠানো হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীরউত্তম, ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী সদস্যের হাতে নিহত হয়েছিলেন। দুষ্কৃতকারীরা নিজেদের বিপ্লবী পরিষদ বলে দাবি করেছিল চট্টগ্রাম বেতারে। তার মৃত্যুর পর সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। ৪০ দিনব্যাপী জাতীয় শোক পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে চট্টগ্রাম রেডক্রসের কর্মকর্তারা বিদ্রোহী দলের নেতা জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ চাইলে তিনি তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, স্পিকার মীর্জা গোলাম হাফিজ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, ঢাকার মেয়র, ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকসহ হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় শরিক হয়েছিলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার মূল নায়ক মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর নিহত হন। পরে জিয়াউর রহমানের মরদেহ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেরেবাংলা নগরের গণভবনের পাশে প্রস্তাবিত পার্কে দাফন করা হয়েছিল। এর আগে প্রায় সতেরো ঘণ্টা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জিয়াউর রহমানের লাশের কফিন রাখা হয়েছিল সংসদ চত্বরে।
দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ২০০২ সালে বিএনপি’র নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি পদে বসেছিলেন ইয়াজউদ্দিন। দলটি ক্ষমতা ছাড়ার পর ২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের সঙ্গেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্বও নেন, যা সে সময় দেশের রাজনীতিতে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান জোটেনি বিতর্কিত এই রাষ্ট্রপতির কপালে।
রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ দেহাবসান ঘটে তার। দীর্ঘদিন রোগে আক্রান্ত হয়ে কিডনি ও মূত্রপ্রদাহে আক্রান্তজনিত কারণে এবং ফুসফুসের সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছিল।
লেখক: ছড়াকার ও তথ্যচিত্র নির্মাতা
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জুলাই ২৩, ২০১৯