উদিসা ইসলাম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ডিসি-১০ বিমানে চড়ে লন্ডন থেকে দেশে ফেরেননি। তিনি কমেট জেট নামের একটি বিমানে চেপে ওইদিন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। দৈনিক বাংলা ও এবিসি নিউজের সচিত্র প্রতিবেদন ঘেঁটে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি মোস্তফা আজিম আওলাদ নামের এক বিমান কেনাবেচাকারী ব্যবসায়ীর ‘বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার বিমান সরকারকে উপহার দিতে চাওয়া’ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে ঐতিহাসিক এ তথ্যটি আবারও আলোচনায় উঠে আসে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এই ক্যাপ্টেন দাবি করেন, ডিসি-১০ বিমানে চেপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে করাচি থেকে লন্ডন ও পরে লন্ডন থেকে ভারত হয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। আর ডিসি-১০ নামের ওই বিমানটি নিলাম থেকে কেনার পর সেটি সরকারকে উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েই মূলত আলোচনায় আসেন তিনি।
গণমাধ্যমে তার এমন দাবির সূত্র ধরে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন শুক্রবার বাংলা ট্রিবিউনেও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সংবাদটি প্রকাশের পর পরই পাঠকদের মধ্যে অনেকে এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানালে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় কমেট জেট বিমানে চেপেই বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন এবং ক্যাপ্টেন মোস্তফার দাবি মোটেও সঠিক নয়।
জানা গেছে, ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের প্রকাশ্য নিলাম থেকে পুরনো ২৩টি বিমান কিনে ভেঙে ফেলা হলেও, ভাঙা হয়নি ওগুলোর মধ্যে থাকা সেই ডিসি ১০ বিমানটি। বিমানটির বর্তমান মালিক রাজবাড়ীর ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিম আওলাদ। ব্রিটেন থেকে এই বিমানটি নিলামে কিনেছিলেন তিনি।
ক্যাপ্টেন আওলাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ডিসি-১০ বিমানের ভিআইপি লগবুক পরীক্ষা করে দেখা যায়, বিমানটিতে চড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে করাচি থেকে লন্ডন ও পরে লন্ডন থেকে ভারত হয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।’
যদিও দৈনিক পূর্বদেশের ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, জাতির জনক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহন করেছিল ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেট বিমানটি। বাংলাদেশ সময় ১টা ৪১ মিনিটে বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরের ভূমি স্পর্শ করে। এদিকে সেইদিনেরই ওয়াশিংটন পোস্টে বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘এরাইভড অ্যাট ঢাকা এয়ারপোর্ট অন ১.৪৫ অ্যাবোর্ড এ ব্রিটিশ রয়াল এয়ারফোর্স কমেট। হি ফ্লিউ ফ্রম নিউ দিল্লি হোয়ার মেট উইথ প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধী অ্যাণ্ড প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি অন হিজ ওয়ে হোম ফ্রম লন্ডন।’
ওয়াশিংটন পোস্ট ও দৈনিক পুর্বদেশ ১১ জানুয়ারি ১৯৭২
অনলাইন ইউটিউবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেয়ার ফুটেজ’ শীর্ষক যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা এবিসি নিউজের ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সম্প্রচারিত ভিডিও ক্লিপটি রয়েছে। (ইউটিউব লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=vy3yYzeF0rA) সেখানে টাইম টানেলে ক্রিস্টায়েন ক্লায়েন উপস্থাপিত ‘এবিসি ট্রাভেলস ব্যাক টু দিস ডে ইন হিস্ট্রি’ অর্থাৎ ইতিহাসের এই দিনে এবিসির ফিরে দেখা অংশটি দেখানো হয়েছে। এতে দুই প্রখ্যাত সংবাদ পাঠক যথাক্রমে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে হাওয়ার্ড কে স্মিথ ও নিউইয়র্ক থেকে হ্যারি রিজনার যুগপৎ ওই ঐতিহাসিক সংবাদ পরিবেশন করেছেন।
তাতে সংবাদ শিরোনামে হ্যারি রিজনারের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘মুজিবুর রহমান রিটার্নস হোম অ্যান্ড টেলস হিজ কান্ট্রিম্যান দ্যাট বাংলাদেশ উইল রিমেইন ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্রম পাকিস্তান।’ অর্থাৎ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে গেছেন এবং দেশবাসীকে জানিয়েছেন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। এরপরই বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশনায় হ্যারি রিজনার পড়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান আজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার স্বদেশে ফিরে গেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পর শেখকে একটি ব্রিটিশ জেট লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা নিয়ে যায়। এবিসির রন মিলার সেই প্রত্যাবর্তন রিপোর্টটি পাঠিয়েছেন।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির দৈনিক বাংলা
যদিও ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর নিলামে তোলা পুরনো তিনটি বিমান কিনে নেয় ব্রিটিশ এয়ারলাইনসের সিনিয়র ক্যাপ্টেন ও প্রশিক্ষক রাজবাড়ীর বাসিন্দা ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিমের মালিকানাধীন ইম্পেরিয়াল এভিয়েশন।তিনটি বিমানের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় কেনা ডিসি-১০ বিমানটির ভিআইপি যাত্রী পরিবহন লগবুক পরীক্ষা করে ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিম জানতে পারেন ওই বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এরপর তিনি বিমানটি আর ভাঙতে দেননি। বর্তমানে লন্ডনে থাকা এই বিমানটি তিনি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।
দৈনিক বাংলা ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ (২)
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের সদস্য ওমর শেহাব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারির পত্রপত্রিকায় একাধিক প্রতিবেদনে লেখা আছে বঙ্গবন্ধু একটি কমেট জেটে করে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। কাজেই এখন ওনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যবহৃত একটি ডিসি-১০ বিমান উপহার দেওয়ার খবর পড়ে আমি একটু অবাক হয়ে গেছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা একটু নথিগুলো যাচাই করে নিলে খুব ভালো হয়।
এ বিষয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডা. আবদুন নূর তুষার টেলিফোনে জানান, ‘বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ডিসি-১০ বিমানের যে ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছে, তিনি আসলে ওই বিমানে আসেননি। তিনি যে কমেট বিমানে করে এসেছিলেন তার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। আমি যেহেতু খেলনা উড়োজাহাজ সংগ্রহ করে থাকি তাই কোনটি ডিসি ১০, আর কোনটি কমেট বিমান সহজে তা চিহ্নিত করতে পারি।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৬