উদিসা ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে বীরত্বের সঙ্গে সংগ্রামরত গণবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগের ঘোষণাসহ অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাসসের সংবাদে জানা যায়, এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী জানান, এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুলিশ বাহিনী ও জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দেশ গড়তে গণবাহিনীর প্রচেষ্টা এবং পরবর্তী উদ্যোগগুলো নিয়ে কথা বলেন। ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও সোভিয়েত কনসাল জেনারেল সাক্ষাৎ গ্রহণ করেন। বাসস,বাংলাদেশ অবজারভার ও দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এইদিনের সংবাদ থেকে জানা যায়, সবাইকে নিয়ে দেশ ও অর্থনীতি পুনর্গঠনে কাজে নেমেছেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী
গণবাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর বার্তা
গণবাহিনীর সদস্যেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হবে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গণবাহিনীর যেসব সদস্য তাদের লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে পারেননি, তাদেরকে জাতীয় উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হবে এবং সব রকমের সুবিধা দওয়া হবে।’
আর যারা পড়ালেখা সম্পন্ন করেছেন তাদের অবিলম্বে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নিজেদের সব শক্তি ও প্রচেষ্টা একটি নয়াসমাজ গড়ে তোলার ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার কাজে নিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ ও আমার সরকারের পক্ষে গণবাহিনীর সব সদস্যকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
বাহিনীর সদস্যরা এককভাবে ও সম্মিলিতভাবে যে দেশপ্রেম দেখিয়েছেন তার তুলনা হয় না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা কখনও বৃথা যাবে না। যে সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা এতদিন দেখেছি— তাই এখন আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এজন্যই আমার সরকার ও আমি নিজে গণবাহিনীর সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা ও একটি নয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে আপনারা আপনাদের সব শক্তি ও প্রচেষ্টা নিয়োগ করেন। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানিরা বাংলাদেশের নয়া সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীতে নেতৃত্ব প্রদান করবে, এটাই সরকার আন্তরিকভাবে কামনা করছে। বাংলাদেশ সরকার একটি নয়া পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছে। এ বাহিনী হবে জনগণেরই পুলিশ বাহিনী। আমাদের বীর গণবাহিনী থেকে লোক নিয়েই এ বাহিনী তৈরি করা যাবে। গণবাহিনীর লোক দিয়েই গড়ে তোলা হবে পুলিশ বাহিনীর অফিসার-মণ্ডলী।
অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু, ১৭ জানুয়ারির অবজারভার
দিনভর নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে আওয়ামীলীগ ও গণপরিষদের সদস্যদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতির আলোকে পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে।’ সরকারি বাসভবনে বিভিন্ন জেলার গণপরিষদের সদস্য ও পার্টি কর্মীদের সঙ্গে এই দিনে পৃথক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত দিন কাটান। সব জেলার স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের কাজে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে পার্টি কর্মীদের আহ্বান জানান। পাকিস্তানি নির্যাতনে যারা জীবন ও বিষয় সম্পত্তি হারিয়েছেন, তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করত্ কর্মীদের আহ্বান জানান।
দেশ গড়ার নীতি বাস্তবায়নে গণবাহিনীকে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা প্রায় সম্পন্ন। জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।’
ইয়াহিয়ার প্রকাশ্য শাস্তির দাবি
৩০ লাখ অধিবাসীকে হত্যা করার অভিযোগে ইয়াহিয়া খানকে প্রকাশ্যে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। বাংলাদেশে ত্রাস সৃষ্টিকারী পাকিবাহিনীর বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এরা পশুর চেয়েও অধম। বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে তারা।’ ফ্যাসিবাদী জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের যেভাবে বিচার করা হয়েছে, সেভাবেই পাকিস্তানি নেতাদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের কাছে দাবি জানান তিনি। সাক্ষাৎকারকালে বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি ছবি দেখানো হলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুজিব বলেন, ‘আমি ক্ষমায় বিশ্বাসী। কিন্তু এহেন গণহত্যাকারীদের, আমার জনগণকে যারা বেপরোয়াভাবে হত্যা করেছে, তাদের কেমন করে ক্ষমা করা যাবে?’
বঙ্গবন্ধুর গায়ে হাত তুলেছিল সৈনিকরা
ব্রিটিশ সাংবাদিকের কাছে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে আটকের ঘটনা বলতে গিয়ে জানান, তাকে গ্রেফতারের সময় বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা তার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করেনি। ব্রিটিশ টেলিভিশনের এক প্রতিনিধিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী চারদিক থেকে আমার ঢাকার বাড়ি ঘিরে ফেলে। দুদিক থেকে মেশিনগানের গুলি চালায়। আমার ছোট ছেলেটি যে ঘরে ঘুমিয়েছিল সে ঘরের জানালা দিয়েও তারা গুলি করে। এক পর্যায়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে; একজন অফিসার আমাকে মেরে না ফেলতে সেনাদের নির্দেশ দেয়। সৈন্যরা তখন আমাকে ধাক্কা দিতে শুরু করে। আমার গায়ে হাত তোলে এবং পেছন থেকে ঘুষি মারে। আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাকে বলে যাই— আমার মৃত্যু হলে আমার জনগণের লজ্জা পাবার কারণ ঘটবে না। কিন্তু আমি যদি নতি স্বীকার করি তবে তারা বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। হানাদার বাহিনী তারপর আমাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা আমার বইপত্র ও ডায়েরিগুলোও নিয়ে যায়।’
সর্বস্তরে বাংলা চালু সম্ভব না হওয়ায় বিবৃতি
সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার না হওয়ায় দেশের ১৪ বুদ্ধিজীবী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সরকার জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের ঘোষণা দিলেও এখনও কিছু প্রতিষ্ঠান সেটি মানছে না উল্লেখ করে এক বিবৃতির মাধ্যমে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের দাবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষার কিছু প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাতে বাংলাকে এড়িয়ে চলছে। বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই, স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ কোনোক্রমেই সাময়িক শ্রেণি বিভেদ সৃষ্টিকারী নানা মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা মেনে নেবে না। শিক্ষাকে গণমুখী, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক করে তুলতে হলে বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ ব্যাপারে সচেতন ছাত্রসমাজকে হুঁশিয়ার থাকতে আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন— ড. এনামুল হক, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, কবীর চৌধুরী, মযহারুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, নিলিমা ইব্রাহীম, আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জান, মনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
শহীদদের তালিকা নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমালোচনা
শহীদদের তালিকা না হওয়ায় নিজেদের সমালোচনা করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। জাতীয় শোক দিবসে তাদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংবাদপত্র প্রকাশ করে ১৭ জানুয়ারিতে। সেখানে আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আজ শোক দিবস পালন করছেন, কিন্তু শহীদ পরিবারের কোনও খোঁজ নিয়েছেন? যাদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেলেন, তাদের সঠিক হিসাব নিতে এগিয়ে এসেছেন? দায়িত্ব কি একা সরকারের?’
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু
আমরা শুধুই সরকারের মুখাপেক্ষী স্বাধীন জাতি কিনা প্রশ্ন তুলে তিনি আরও বলেন, ‘জাতিগত দায়িত্ব হলো শহীদদের তালিকা প্রণয়ন, তাদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দেওয়া।’ ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল ভৌগোলিক মুক্তিই নয়। ভৌগোলিক মুক্তি চিরস্থায়ী হতে পারে না, যদি আদর্শের বাস্তবায়ন না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর কাছে তার বার্তা
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান— তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিশ্বে ন্যায়বিচার আদালত করতে চলেছেন। তারা একটি খসড়া গঠনতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পরিচালনার কাঠামো প্রস্তুত করেছে। বিভিন্ন সময় তারা জানিয়ে দিয়েছেন যে, নির্যাতন নিপীড়নের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার বিশ্বের বিচারপতিদের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতে অগ্রাধিকার পাবে। শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়— ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের নকশা প্রদর্শন করা হবে। প্রকাশ্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা নকশা বাছাই করা হবে। নকশা প্রস্তুতে ইচ্ছুকদের ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নাম জমা দিতে বলা হয়।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০২০