উদিসা ইসলাম
সরকার দেশে নতুন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছে জানিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজের নীতি ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই নানা সময়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলবেন জানালেও আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।
বঙ্গবন্ধু দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের দৃঢ়তার কথা পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি সরকারি বাসভবনে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়নে দক্ষ অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ দেওয়ার কথাও জানান। তিনি বলেন, অর্থনীতি এক বিধ্বস্ত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা। অর্থনীতিকে অবশ্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্র অবশ্যই দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই আবার চালু হতে হবে। সব শ্রেণির মানুষ যাতে শিক্ষার সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
কৃষি শিল্প ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচনার মধ্য দিয়ে নয়া অর্থনীতি সৃষ্টির কাজে হাত দেওয়া হয়েছে বলেও জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এখন সরকার এই ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়। ইয়াহিয়া খানের দস্যুবাহিনী বাংলাদেশ ধ্বংসের যে চিহ্ন রেখে গেছে, তার ওপরেই নয়া সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি বলেন, অর্থনীতির ধরন হবে সমাজতান্ত্রিক। বাঙালি তাদের প্রয়োজন অনুসারে সমাজতান্ত্রিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে। অর্থনীতি পুনর্গঠনে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি সহায়তাও আহ্বান করেন প্রধানমন্ত্রী।
অবজারভারে ১৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ প্রকাশিত হয়
নৃশংসতায় দায়ীদের বিচার হবে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ যাতে জাতি গঠনমূলক কাজ শুরু করতে পারে তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার একটি কাঠামো আবশ্যকতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। পাকিস্তানি বাহিনী নিষ্ঠুরতায় নির্যাতিত ও তাদের স্থানীয় দালালদের মধ্যে এই মুহূর্তে তিক্ততা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক এতদসত্ত্বেও তারা যে সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে তা খুবই প্রশংসনীয়। আমি আমাদের জনগণকে আশ্বাস দিচ্ছি যে নৃশংসতার জন্য দায়ী ও তাদের দালালদের শাস্তি দেওয়া হবে।
সেই সঙ্গে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাভাজন হওয়া, দুষ্কৃতকারীদের আইনের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। আইন তার গতিধারায় চলবে, কাজেই আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্যধারণের আবেদন জানাচ্ছি।
বিচারবিভাগ নিয়ে উদ্যোগ
হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতগুলো যাতে কাজ শুরু করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমি সুনিশ্চিত করে দিতে চাই যে দুর্নীতি ও কালক্ষেপণ উচ্ছেদ করার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারব্যবস্থার কতগুলো মৌলিক ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নীতি কবে পর্যালোচনা করা হবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা সাহায্য পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এর জরুরি কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করার জন্য গণপরিষদের অধিবেশন ডাকার ব্যাপারে প্রয়োজনের চাইতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করবো না। শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে বঙ্গবন্ধু
হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তাদের যথোপযুক্ত চাকরিসহ নানা সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতের কথা জানান বঙ্গবন্ধু। দেশের স্বাধীনতার জন্য যেসব তরুণ যুদ্ধ করেছে সমাজে তাদের যথাযথ স্থান পাওয়া উচিত যাতে করে তারা দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত
প্রত্যাবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে একে একে স্থগিত হয়ে থাকা কাজগুলো সম্পন্ন করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ১৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী প্রকাশ্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শহীদ মিনার পুনর্গঠনে নকশা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত হয়। সেরা নকশা নির্বাচনে কমিটিও করা হয়। এদিকে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ছিল পার্টির কোনও কর্মকর্তা সরকারি পদ নিলে তাকে পার্টির পদ ত্যাগ করতে হবে। এই গঠনতন্ত্র অনুসারে বঙ্গবন্ধু পার্টি প্রধানের পদে না থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিন নিজ বাসভবনে সরকার প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান জানান, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বই পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হবে। প্রথম নীতি নির্ধারণী বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বানাতে চান বলেও ইচ্ছা পোষণ করেন।
এপ্রিল থেকে নির্জন সেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু
এদিন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানে আটক করে নিয়ে গিয়ে কী করা হয়েছিল তার ওপরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তার বাড়ি আক্রমণ করে। মেশিনগানে গুলি চালায় ও বাড়ির সমস্ত জিনিস ধ্বংস করে। এরপর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর কয়েকদিন তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটক রাখা হয়। ১ এপ্রিল বিমানযোগে করাচি নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তাকে মিনওয়ালি জেলে স্থানান্তরিত করে এবং একটি নির্জন সেলে আটক রাখে। তাকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয় এবং অন্যদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হতো না। চিঠিপত্র লিখতেও দেওয়া হতো না। জেলখানায় কোনও সংবাদপত্র বা রেডিও দেওয়া হয়নি তাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একথা কখন জানতে পারেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমিই আন্দোলন শুরু করি, আমি জানি কখন আমার জনগণ স্বাধীন হবে।’
পত্রিকা কার্টেসি: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২০