সমানাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান নিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনতন্ত্র প্রস্তুত

উদিসা ইসলাম

সমানাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা আর চিন্তার স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রক্ষার বিধান নিশ্চিত করার অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রায় প্রস্তুত হয়ে এসেছে। দৈনিক বাংলা এনার বরাত দিয়ে করা খবরের সূত্র ধরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই দিনে। সেখানে বলা হয়, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র মূলনীতি ও ব্যক্তির মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্যের নিশ্চয়তা নিয়ে শাসনতন্ত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে গণপরিষদের বৈঠক বসবে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। খসড়া শাসনতন্ত্রে এককেন্দ্রিক পার্লামেন্টারি সরকারের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন পরিষদ হবে এককক্ষ বিশিষ্ট এবং এর সদস্য সংখ্যা হবে ৩৫০।

আইন ও পার্লামেন্টারি দফতরের মন্ত্রী কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত খসড়া প্রণয়ন কমিটি প্রথমে খসড়াটি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে পেশ করবে। সেখানে বিবেচনায় নেওয়ার পরে সেটি বাংলাদেশ গণপরিষদে পাঠানো হবে বলেও সংবাদে প্রকাশ করা হয়।

এনার খবরে প্রকাশ, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী একমাসের মধ্যে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসতে চলেছে। শাসনতন্ত্রের শুরুতে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এই মূলনীতির ভিত্তিতে এদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত হবে। খসড়া শাসনতন্ত্রে সমাজতন্ত্রী ধাচের অর্থনীতি, প্রশাসনিক বিভাগ থেকে আইন বিভাগকে আলাদাকরণ, ব্যক্তিমর্যাদা ও জাতীয় ঐক্যের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। এককক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদে ৩৫০ জন সদস্য সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। আইন রিষদের ভোটে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা।

নাগরিক কারা

নাগরিকত্বের অধিকারের বিষয়ে শাসনতন্ত্রে বলা আছে, বাংলাদেশে যারা জন্মেছে বা যাদের বাবা বা মায়ের জন্মস্থান বাংলাদেশ, অথবা পাঁচ বছর যারা বাংলাদেশে বসবাস করছে, তারা সবাই নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারবে।

মৌলিক অধিকার প্রশ্নে

আইনের চোখে সবার সমান অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রক্ষার বিধান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া গণতন্ত্র, সাম্য, সহনশীলতা, সামাজিক ন্যায় পরায়ণতা, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশে অনুসরণ করা হবে।

পাকিস্তানকে বাস্তবতা বুঝতে বললেন বঙ্গবন্ধু

এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের দৈনিক বাংলা পত্রিকা ছেপেছে— পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে মুজিব বলেন, ‘প্রথমে তাদেরকে বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে এবং  স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। স্বীকৃতি দেওয়ার পর দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হতে পারে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠাকরণ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জার্মান এবং ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।  যুদ্ধের পর সেখানে কোনও ফ্যাসিস্ট ছিল না, শুধুই ছিল হিটলারের একনায়কতন্ত্র।’

  

মার্কিনিরা বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চায়

মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের বন্ধুত্ব কামনা করে বলে বার্তা দেন মার্কিন সিনেটর স্টিভেনসন। বাসস ও পিটিআই এর আরেক খবরে বলা হয়— কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এই ডেমোক্র্যাট সিনেটর। সিনেটর স্টিভেনসন কলকাতায় বলেন, ‘মার্কিন জনগণ বাংলাদেশিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব।’ বাসসের খবরে বলা হয়, এই দিন সিনেটর ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটান।

তার বাংলাদেশ সফরকে তথ্য সন্ধানী সফর বলে উল্লেখ করেন স্টিভেনসন। বাংলাদেশে আসার আগে দমদম এয়ারপোর্টে তিনি বলেন, বাংলাদেশে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে  সাক্ষাৎ করবেন। তবে মার্কিন অবস্থান বিষয়ে তার নিজের মতামত তিনি জানাতে চাননি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মনোভাব নিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘আমি এটুকুই বলতে পারি, মার্কিন জনসাধারণ বিশ্বের সব স্থানের জনসাধারণের অধিকারের প্রতিই সমর্থন জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশের জনসাধারণের দুর্ভাগ্যের ব্যাপারেও তাদের সহানুভূতি রয়েছে।’

আবারও সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনীতি

এএফপি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু আবারও বলেন, তিনি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি বলেন যে, তিনি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনীতিতে বিশ্বাস করেন এবং তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চান। কারণ, এটা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বলে মনে করেন। এর আগে শেখ মুজিব বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ডের মতো তৈরি করতে চান। তিনি বলেছেন, তার সরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর ভিত্তি করে একটি পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন করবে। অভ্যন্তরীণ নীতি প্রসঙ্গ আসলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র। আমি বাস্তবতায় বিশ্বাসী। আমি কাউকে কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি নিশ্চিত হতে পারি যে, সেটা করার সক্ষমতা আমার আছে কিনা।’ মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ থামাতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু নির্দিষ্ট শিল্পকে জাতীয়করণ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি বিষয় ছিল আমার মানুষের জন্য খাবার, কাপড় এবং আশ্রয়ের স্থান দেওয়া।

ফারাক্কা প্রশ্নে আলোচনা হবে

বন্যা নিয়ন্ত্রণ সেচ ও বিদ্যুৎ উন্নয়নের বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে ভারত আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি ফারাক্কা নিয়ে আলাপের বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে দুই দেশের। প্রধানমন্ত্রীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ সেচ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা বিএম আববাস একথা জানান। ভারতে সাত দিনের সফর শেষে তিনি এই দিনে দেশে ফেরেন। নয়াদিল্লিতে ভারতীয় মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফারাক্কা ইস্যুতে সাধারণভাবে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে এই মর্মে মতৈক্য হয় বলে জানান যে, উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষায় ফারাক্কা প্রশ্নে সবদিক নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। নয়াদিল্লি থেকে ফিরে বিমানবন্দরে বিএম আব্বাস সাংবাদিকদের বলেন,

‘আলোচনায় আমি সন্তুষ্ট। ফারাক্কা প্রশ্নে সাধারণভাবে আলোচনা হয়েছে এবং পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে বাসস ও এনার খবরে বলা হয়। 

  

প্রশাসন পরিচালনায় সেনাবাহিনীর কিছু করণীয় নেই

বাংলাদেশে আজ রাজনীতি নয়, এখন গণনীতি। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী সিলেটে রেজিস্ট্রি ময়দানে জনসভায় একথা বলেন। তিনি বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেন, রাজনীতি হলো ক্ষমতা দখলের রাজনীতি আর গণনীতি হলো গণমানুষের সেবার রাজনীতি। দেশে এখন সামরিক আইন নেই, জনগণের ভোটে জয়ী নেতারা দেশ শাসন করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেকারণে সশস্ত্রবাহিনী জনগণের সার্বভৌমত্ব ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। প্রশাসন পরিচালনায় সেনাবাহিনীর কিছু করণীয় নেই।

পত্রিকা কার্টেসি: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০২০

SUMMARY

2453-১.jpg