প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম বিদেশ সফরে বঙ্গবন্ধু, সঙ্গী ১৭ জন

উদিসা ইসলাম

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এই প্রথম দেশের বাইরে যাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আগামীকাল ৬ ফেব্রুয়ারি ১৭ জনের প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি কলকাতা যাবেন। কলকাতায় অবস্থানকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হওয়ার কথা। দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পরকে সহযোগিতা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি বজায় রাখা সম্পর্কে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানানো হয়। ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধুর আগমনের শুভ মুহূর্তটির জন্য সমগ্র কলকাতা নগরী রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় রয়েছে।

এদিকে দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের মতামতের প্রতিফলন রাখার আহ্বান জানায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর)।

দুই দিনের সফরে কলকাতা যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

দৈনিক বাংলার ৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম পৃষ্ঠার অনেকটা জুড়েই ছিল এই খবর। বঙ্গবন্ধুর কলকাতায় যাওয়া, সেখানকার প্রস্তুতি, কী নিয়ে আলোচনা হতে পারে—সেসব খবরের বিস্তারিত ছিল পত্রিকার পাতায়। খবরে বলা হয়, ঐতিহাসিক কলকাতা নগরী আজ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমাণ, বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে প্রতীক্ষারত। বঙ্গবন্ধু তাদের দেওয়া কথা রেখে এই সময়ে যাত্রা করছেন বলে মহাসমারোহে তাকে বরণের আয়োজন হয়েছে। পত্রিকার খবর বলছে, ১০ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তনের সময় দিল্লি থেকে ঢাকা ফেরার পথে নেতাকে এক নজর দেখার জন্য সারা কলকাতা সেদিন ছিল অধীর। দমদম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু সেদিন নামতে পারেননি। কিন্তু কথা দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গবাসীকে বলেছিলেন—‘প্রথম সুযোগেই আপনাদের মাঝে আসবো।’ সেই কথা রাখতেই বঙ্গবন্ধু আগামীকাল সকাল সোয়া ১০টায় প্রথম ভারত সফর ও প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাবেন একটি বিশেষ বিমানে করে। বিমানটি দমদমে নামবে সকাল ১০টায়। এর মিনিট ১৫ আগেই দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন তিনি। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা সংবর্ধনা শেষে বঙ্গবন্ধু যাবেন রাজভবনে একটি হেলিকপ্টারে করে। তার সঙ্গে থাকবেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। হেলিকপ্টারগুলো নামবে মোহনবাগান ময়দানে। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে করে যাবেন রাজভবনে। মোহনবাগান ময়দান থেকে রাজভবনে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু  দুই জায়গায় থামবেন। প্রথমে থামবেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মূর্তির পাশে, এরপর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিমূর্তির সামনে—দুই নেতার মূর্তিতে তিনি পুষ্পমাল্য প্রদান করবেন।

সেখানে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে তিনটায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার কথা। তাঁর ভাষণের আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন খ্যাতনামা শিল্পীরা সেখানে কোরাস গাইবেন বলেও জানানো হয়।

  

ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর তরফে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া ঐতিহাসিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ঢাকাবাসী বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখতে পাবেন বলেও নিশ্চিত করা হয়।

১৭ জন সফরসঙ্গী

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সফরে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে ১৭ জনের তালিকা নিশ্চিত হয়েছে। তারা হলেন—পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্র সেক্রেটারি এম এ করিম, তথ্য সেক্রেটারি হোসেন আলী, অর্থ সেক্রেটারি মতিউল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব রফিক উল্লাহ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল ও প্রেস সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম। এছাড়া জনসংযোগ ডিরেক্টর জেনারেল এম আর আখতার ও সহকারী প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা গত শুক্রবার কলকাতা গেছেন।

বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের কারাগারে ৯ মাস বাস করার পর লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সময় কলকাতায় অল্পক্ষণের জন্য নামবেন, এই ভরসায় ১০ জানুয়ারি হাজার হাজার লোক দমদম বিমানবন্দরে অপেক্ষা করলেও সেদিন তিনি সময়ের অভাবে নামতে পারেননি। সেই সময় তিনি কলকাতাবাসীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, প্রথম সুযোগেই তিনি কলকাতা সফর করবেন।

দুই দফা আলোচনা হবে

কলকাতায় এই সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী  দুই দফা আলোচনায় মিলিত হবেন। তারা এশিয়ার বিভিন্ন সমস্যা ও উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন বলে প্রাথমিকভাবে সেসময় জানা যায়। দমদম বিমানবন্দর থেকে রাজভবনে গিয়ে এই দুই মহান নেতা প্রথম দফা আলোচনা শুরু করবেন। এ সময়ে প্রধানত এশিয়ার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। এসব সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবেন। বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে পাকিস্তান যে মনোভাব গ্রহণ করেছে, প্রথম দফা বৈঠকে সম্ভবত তাও আলোচিত হবে বলে দৈনিক বাংলায় খবর প্রকাশ করা হয়।

পত্রিকাটি বলছে, দুই নেতার নির্ধারিত আলোচ্য সূচি প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল থেকে জানা গেছে, দুই নেতা যুদ্ধবন্দিদের বিষয় নিয়ে এবং পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফেরত আনার বিষয় নিয়েও আলোচনা করবেন।

  

প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ তহবিল

বাংলাদেশে ত্রাণ কাজের জন্য দানশীল ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ‘প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ তহবিল’ নামে একটি তহবিল খোলা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি বিপিআই’র খবরের প্রকাশ—এই তহবিলের জন্য সাহায্য গ্রহণ করবে ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন, ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে যারা সাহায্য করতে চান, তাদের চেক বা মানিঅর্ডার, অথবা নগদ অর্থ পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়।

  

শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সব দলের মত গ্রহণের সুপারিশ

দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে হবে বলে সুপারিশ জানায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর গ্রুপ)। ৫ ফেব্রুয়ারি কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা থেকে এই সুপারিশ করা হয়। বাসসের খবরে বলা হয়, তারা জাতির পুনর্গঠনে সরকারকে দলের (ন্যাপের) পূর্ণ সহযোগিতা ও সাহায্যের আশ্বাস দেয়।

ন্যাপ সম্পাদক আলতাফ হোসেন তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি জরুরি ভিত্তিতে পুনর্গঠন না করা হলে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের খেলা এখনও শেষ হয়নি।’ তিনি জনগণকে যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। ন্যাপ নেতা বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকার জন্য চীনা নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা করেন। বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরার জন্য তিনি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের জনগণ ও সরকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২০

SUMMARY

2451-১.jpg