বিবিসিতে বাজলো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’

উদিসা ইসলাম

৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। তখনও দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে আত্মগোপনে রয়ে গেছে বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্য। যেখানে-সেখানে মাইন পেতে রাখা হয়েছে। ঢাকাতেই কয়েকটি অঞ্চলকে প্রায় অবরুদ্ধ করে রেখেছে দুষ্কৃতিকারীদের সহায়তায়। ১৯৭২ সালের এইদিনে এমনই একটা পরিস্থিতিতে বিবিসি রেডিওতে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ বাংলাদেশকে গ্রেট ব্রিটেন স্বীকৃতি দেওয়ার খবর প্রচারের সময় বেজে ওঠা জাতীয় সংগীত সেদিন অন্য আবেগ নিয়ে শুনেছিল মানুষ। আর এই স্বীকৃতির পর কমনওয়েলথের সদস্য হওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান বঙ্গবন্ধু।

মিরপুরে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ

বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী মিরপুরে তল্লাশি চালিয়ে বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে আটক করেছে। তল্লাশি অভিযানের বিরুদ্ধে কিছু দুর্বৃত্তকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক প্রতিরোধ করে। দৈনিক বাংলার খবরে প্রকাশ করা হয়, সরকারের মুখপাত্র জানায়— পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র মর্টার ব্যবহার করেছিল। এই অভিযানের সময় পুলিশসহ বেশকিছু মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। মিরপুর থেকে বিতাড়িত বাঙালি পরিবারের কেউ কেউ যখন ৩১ জানিুয়ারি ফিরে আসছে, তখন তাদের লক্ষ্য করে গুলি করার বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া যায়। এমনকি একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর একটি দল যখন এলাকায় অস্ত্র সমর্পনের নির্দেশনা ঘোষণা করছিল মাইকে, তখনও তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। ওই এলাকায় এরকম একাধিক উসকানির পরেও সশস্ত্র বাহিনীকে সংযত থাকারই নির্দেশ দিয়ে আসছিল সরকার। সরকার যদিও জানতো যে, মিরপুর এলাকায় বেশকিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য আত্মগোপন করে আছে। সেখানে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত রয়েছে। তা সত্ত্বেও মানবিক কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে হুট করে কিছু না করতে নির্দেশ দেওয়া ছিল। কিন্তু এসব সেনাবাহিনী যখন পদে পদে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের তল্লাশিকে বাধাগ্রস্ত করে যাচ্ছিল, তখন তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

মাইনে উড়ে যাচ্ছিল কত মানুষ

দুষ্কৃতিকারীরা মিরপুরজুড়ে মাইন পেতে রেখেছিল। স্বাধীন হওয়ার প্রায় দুই মাস পরেও নিহত হচ্ছে মানুষ। রাস্তার আশেপাশে গোলাবারুদ মজুত করে রাখা হয়েছে। গুলি বিনিময়ের সময় এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান এই এলাকায় তার ভাইকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। তাকে (জহির রায়হান) খুঁজতে গত কয়েকদিন একাধিক অভিযান চালানো হয়। কেবল ঢাকায় না ঢাকার বাইরে জামলপুরে মাইন বিস্ফোরণে সাত জনের নিহতের খবর পাওয়া যায়।

১৯৭২ সালের একইদিনে কেবল মিরপুর নয়, মোহাম্মদপুর এলাকাতেও তল্লাশি করা হয় এবং সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। মিরপুরের এক ও দুই নম্বরেও অভিযান চলে। পুরো মিরপুরেই সান্ধ্য আইন  তখনও জারি অব্যাহত ছিল। পরিস্থিতি যেন আরও ঘোলাটে করার কোনও সুযোগ দুষ্কৃতিকারীরা না পায়, সেই ব্যবস্থা নিতেই এই সান্ধ্য আইন।

  

বিবিসিতে সোনার বাংলা

বিবিসিতে বাজলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। ৪ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া আটটার দিকে বাংলাদেশকে ব্রিটেনের স্বীকৃতি দেওয়ার খবরটি প্রচারের সময় বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য স্টোন সেদিন হাউস অব কমন্সে বাংলায় বক্তৃতা করেন। এপির বরাত দিয়ে দৈনিক বাংলার খবরে প্রকাশ— ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেস ডগলাস ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় নয়াদিল্লি আসছেন। তবে তিনি এও আভাস দেন যে, এ যাত্রায় তিনি বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন না।

কমনওয়েলথের সদস্যপদ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কমনওয়েলথের সদস্য হওয়া ও ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে।’ ৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেন স্বীকৃতি ঘোষণা করার পরে প্রধানমন্ত্রী এ তথ্য প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের কাছ থেকে আমি বাণী পেয়েছি। এতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, মানবিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ধাত্রীদেশ গ্রেট ব্রিটেনের স্বীকৃতি পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রিটেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ এনা পরিবেশিত খবর বলছে, বাংলাদেশকে পশ্চিম জার্মানি স্বীকৃতি দেওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান তার সরকার ও তার জনগণের পক্ষ থেকে পশ্চিম জার্মানিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং পশ্চিম জার্মানি বাংলাদেশের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

  

জাতীয় মিলিশিয়ায় যোগ দিতে চান কাদের সিদ্দিকী

টাঙ্গাইলের গেরিলা কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী ৪ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) সচিবালয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই গেরিলা সংগঠন ‘কাদের বাহিনী’ নামে পরিচিত। কাদের সিদ্দিকী বাসসকে জানায়, তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দেশের সব স্থানে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে তার নিজের ও বাহিনীর সহযোগিতার কথাও জানিয়েছেন। তার বাহিনী জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে যুক্ত হতে আগ্রহী বলেও জানান।

কলকাতা সাজছে বঙ্গবন্ধুর জন্য

কলকাতা উৎসবের নগরী হয়ে উঠেছে এই সময়টায়। সেখানে পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্ত থেকে লোক আসছে বঙ্গবন্ধুকে ৬ ফেব্রুয়ারি একবার চোখের দেখা দেখবে বলে। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ১০ লাখ লোকের বসার আয়োজন করা হয়েছে বলে কলকাতা থেকে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন। ময়দান সাজানো হয়েছে তোরণ দিয়ে, যতদূর পর্যন্ত সম্ভব মাইকের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। আর  এই বিশাল আয়োজন সুষ্ঠুভাবে করতে দিনরাত শ্র্রমিকরা কাজ করে চলেছেন। জানা যায়, দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য তিন শতাধিক আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল।

 সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২০ 

SUMMARY

2450-১.jpg