উদিসা ইসলাম
কলকাতায় এক নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তির পর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে একজন অবাঙালিকেও হত্যা করা হয়নি। কলকাতা সফরে এদিন (৭ ফেব্রুয়ারি) বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন তিনি। তিন দফা বৈঠক শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এই দুই দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক প্রশ্নে পূর্ণ মতৈক্যে পৌঁছান।
এদিকে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর প্রধান খান আব্দুল ওয়ালী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে খান আব্দুল ওয়ালী বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই জনাব ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারবেন।’
বদলা নিতে একজন অবাঙালিকেও হত্যা করা হয়নি: বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে সব মতাবলম্বী লোক সমান অধিকার ভোগ করবেন। রাজ ভবনে কলকাতা করপোরেশন আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যে চারটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। তার সরকার বিভিন্ন মতাবলম্বী লোকের মধ্যে কোনও পার্থক্য করবে না।’ শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির পর একজন অবাঙালিকেও প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে হত্যা করা হয়নি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার বর্বর পাক বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী কখনও প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করেনি। যদি চাইতো তবে বাঙালি হত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতাকারী সব অবাঙালিকেই তারা ১৬ ডিসেম্বরে খতম করে দিতে পারতো।’

তবে তিনি বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালিদেরকে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘যদি তারা তাই করে তবে আমাদের মতো তারাও হবে বাংলাদেশের নাগরিক।’ তিনি বলেন, ‘তাদেরকে এখানে অবশ্যই বাঙালি হিসেবে বসবাস করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি অথবা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কেউই প্রতিশোধ গ্রহণে বিশ্বাস করেন না। কাজেই বাংলাদেশে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘কতিপয় মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, অবাঙালিদের ওপর নির্যাতন চলছে এবং তারা সংবাদপত্রে মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক বিবৃতি দিচ্ছে।’
মুজিব-ইন্দিরা পূর্ণ সমঝোতা
বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দুই দফা বৈঠকে মিলিত হন। তৃতীয় ও শেষ বৈঠক শেষে নয়াদিল্লি যাওয়ার প্রাক্কালে মিসেস গান্ধী দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনা অত্যন্ত সন্তোষজনক।’ এদিকে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, আলোচনা অত্যন্ত দরকারি ও ফলপ্রসূ ছিল। দুই দেশের সব মূল ও প্রধান প্রশ্নে মতৈক্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক, বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন। অধিকাংশ সময়ই শুধু দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে বৈঠকে যোগদান করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ ও ভারতের শিক্ষামন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। তারা বাংলাদেশ ও ভারত জড়িত রয়েছে এরকম সমস্যা সম্পর্কে দুই দেশের একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভাবন করেন।
শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বললেন বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় বলেন, ‘সব রকমের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ বদ্ধ পরিকর।’ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া এত কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে বলেও তিনি জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে ধনীদের আরও ধনী হতে এবং গরিবদের আরও গরিব হতে দেওয়া যাবে না। হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য ভারতীয় সাংবাদিকরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে সত্যকে তারা তুলে ধরেছেন বিশ্বের সামনে। তখন যদি ভারতীয় সাংবাদিকরা সেটা না করতেন, তাহলে দেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে বিদেশি সাহায্য পাওয়া অসম্ভব হতো।’
বাংলাদেশ মিশনে বঙ্গবন্ধু
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ মিশনে এক সমাবেশে বাংলাদেশকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন, তা রক্ষা করাও তেমনই কঠিন কাজ।’ তিনি মিশনের কর্মচারীদের প্রতি কঠোর পরিশ্রম করার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ রক্ষা করার আবেদন জানান। পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ মিশন পরিদর্শনে গেলে তার সঙ্গে মিশনের কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তথ্য সেক্রেটারি হোসেন আলী মিশন ভবনে বাংলাদেশের যে পতাকাটি প্রথম ওড়ানো হয়, সেটি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিলে তিনি তা জাদুঘরে রাখার পরামর্শ দেন।
পাঁচ জন ছাত্রনেতা: শিক্ষানীতি কী হবে
সবার মুখে একই কথা ও একই দাবি— আমাদের শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন চাই। শিক্ষানীতিতে থাকতে হবে শ্রেণিহীন গণমুখী সর্বজনীন ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। আর সেটাই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা। ছাত্রদের প্রিয় নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব,আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন— বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে সম্পূর্ণ শ্রেণিহীন এবং গণমুখী। কোনও বিশেষ শ্রেণির জন্য কোনও বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা চলবে না।
উদাহরণ স্বরূপ তারা বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং ক্যাডেট স্কুল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলেন— এগুলো অবশ্যই বাংলাদেশে থাকতে পারবে না।শিক্ষানীতিতেকৃষক-শ্রমিক চাকরিজীবী, বুদ্ধিজীবী প্রত্যেকের সন্তানের জন্য একই শিক্ষা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আসম রব বলেন, ‘যতদিন না সরকার সব শিক্ষাকে অবৈতনিক করতে পারছেন, ততদিন ছাত্রছাত্রীদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া উচিত।’ নূরে আলম সিদ্দিকী কারিগরি চিকিৎসা, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি শিক্ষার অর্ধাংশ হাতে-কলমে করার ওপরে গুরুত্বারোপ করেন। ছাত্রনেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন বলেন, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কাউকে পাঠানো চলবে না। সেই অর্থে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে হবে।’ সামরিক শিক্ষার প্রশ্নে তারা সবাই বলেন যে, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে স্কুলজীবনের শেষ দুই বছর অর্থাৎ নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন সামরিক শিক্ষা নিতে হবে। এটা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে এবং বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। মাদ্রাসা শিক্ষা থাকা উচিত কিনা— এ প্রশ্নের জবাবে চার নেতা বলেন, অনুৎপাদনশীল কোনও শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চাই না। তবে স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা একটি ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে থাকতে পারে। সেটা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য সহ ধর্মীয় শিক্ষা হতে হবে।
ভুট্টোর প্রতি ওয়ালি: বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আব্দুল ওয়ালী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে খান আব্দুল ওয়ালী বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারবেন।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২০