উদিসা ইসলাম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার এক মাস পর থেকেই শুরু হয় দেশ গঠনের নানা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের নানা কাঠামো নিয়ে যেমন কাজ শুরু করেন, একইসঙ্গে তার সংগঠন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়গুলো নিয়েও জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ অব্যাহত রাখেন। জামায়াতে ইসলামের আমিরসহ ৫৪ দালালের সম্পত্তি ক্রোকের সিদ্ধান্তটি ছিল বেশ উৎসাহ উদ্দীপক। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে দেশের অনিষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বেশকিছু প্রতিবেদনও প্রকাশ হয় সেই সময়ের সংবাদপত্রে।
৫৪ দালালের সম্পত্তি ক্রোক
বাংলাদেশ সরকার বেআইনি ঘোষিত জামায়াতে ইসলামির আমির মাওলানা আব্দুর রহিম, কনভেনশন লীগের সভাপতি শামসুল হুদা, আইয়ুব আমলের জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার ও কনভেনশন লীগের এটিএম এ মতিন, অ্যাডভোকেট আলী মোহাম্মদ আলীসহ ৫৪ ব্যক্তির নাম বা বেনামিতে রাখা স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে সরকার। এদের সবাইকে ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকাল তিনটাযর মধ্যে নিজ নিজ এলাকার মহাকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত এড়ানোর উদ্দেশ্যে তারা সবাই তখন পলাতক ছিলেন। বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের ১৭ ধারা বলে এই নির্দেশ জারি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অভিযুক্তরা নির্ধারিত সময়ে হাজির হলে সরকার ক্রোক রদের নির্দেশ দিতে পারেন বলেও উল্লেখ করা হয়।
সংগঠনের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু
এই দিনে আওয়ামী লীগের বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ১৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম বৈঠকে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দলীয় সাংগঠনিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এদিন সংগঠনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সভাটি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দলের নিহত নেতাকর্মী ও দেশবাসীর জন্য শোক প্রকাশ করে দোয়া চাওয়া হয়। কমিটির বৈঠকের পর তাজউদ্দিন আহমেদ জানান যে, দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে কেউ একইসঙ্গে মন্ত্রী ও দলীয় কর্মকর্তা থাকতে পারেন না। তারা একসঙ্গে উভয় পদে অধিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা করবেন না। তিনি জানান, দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধনের অধিকার ওয়ার্কিং কমিটির নেই। তবে সংশোধন কমিটি সুপারিশ করতে পারে এবং সেটা দলের কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমোদন করতে হবে।
স্বস্তি পরিষদের প্রতিবেদন
জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য প্রায় ৪১১ কোটি টাকার সাহায্য প্রয়োজন। সেক্রেটারি জেনারেল ওল্ডহেম্যান বলেছেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য এ বছরের বাকি সময়ের জন্য ৪১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে। বিশ্বের দেশগুলো সাধ্য মতো প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘শরণার্থীদের জন্য ঢাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ কাজ বাড়বে।’ মাসে দুই লাখ টন খাদ্যশস্য দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে সরকার চলতি মাসগুলোতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় সংস্থাগুলোর কাজকর্মের জন্য ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করার চিন্তা করছে বলে পিবিআই পরিবেশিত খবরে প্রকাশ করা হয়। পল্লি এলাকায় জাতীয় পুনর্গঠনে পল্লি জনগণকে কাজ দেওয়ার জন্য সরকার এরইমধ্যে টেস্ট রিলিফ হিসেবে ১৬ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। আগামীতে পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় তৎপরতায় ১৫ কোটি টাকা খরচ হবে বলেও পরিকল্পনা করা হয়।
একুশ উদযাপনের তৃতীয় দিন
১৯৭২ সালে প্রথমবার বাংলার স্বাধীন জনগণ একুশ ফেব্রুয়ারিকে নিজেদের মতো করে স্মরণ করছে। এজন্য নেওয়া সাত দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির তৃতীয় দিন ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের মতো করে কাজ করছেন। অনুষ্ঠানের যেন বিরাম নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবছরের শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য যেসব কর্মসূচি পালন করবে, তার মধ্যে শহীদদের মাজারে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও রয়েছে— বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সরকারি-বেসরকারি ভবনে পতাকা অর্ধনমিত রাখাসহ নানাবিধ কর্মসূচি।
সাত দিনের মধ্যে দখলে রাখা বাড়ি ছাড়তে হবে
সাত দিনের মধ্যে বেআইনিভাবে দখল করা বাড়ি ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকার অনুমোদিত লোকদের প্রতি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল না করার এবং ইতোমধ্যে যেসব বাড়ি দখল হয়েছে, তাদেরকে ওইসব বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০