উদিসা ইসলাম
১৯৭১ সালের মার্চের শুরুর দিনেই গর্জে ওঠে বাংলাদেশ। জানা যায়, ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা ছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। এ কারণে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। তারা রাজধানীর পূর্বাণী হোটেলের সামনে জড়ো হলে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। ঠিক একবছর পর ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। এসময়ে রাশিয়ার আকাশ-বাতাস জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
২ মার্চ ১৯৭২ এর পত্রিকা, রাশিয়ায় বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন
সে এক অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা
১৯৭২ সালে রাশিয়া সফরে গেলে বঙ্গবন্ধুকে যে সংবর্ধনা জানানো হয়, তা চিরকাল মনে রাখবে ইতিহাস। বিমানবন্দরে যখন তাকে বহনকারী বিমান পৌঁছে, তখন গুঁড়িগুঁড়ি তুষার পড়ছিল। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনকে আন্তরিক সংবর্ধনা জানিয়ে বলেন, ‘তুষার হয়তো আপনাকে বিব্রত করবে।’ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী—‘মস্কোর তুষারের জন্য আমি প্রস্তুত। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলাম আমি সোভিয়েত বন্ধুদের দেখার জন্য।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই ভ্রমণে ছিলেন বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি আতাউস সামাদ। তিনি তার পাঠানো প্রতিবেদনে জানান—বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য মস্কো বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছিল হাজার হাজার সোভিয়েত নাগরিক। তাদের হাতে ছিল সেই দেশের পতাকা। ‘জয় বাংলা’ ‘বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে ছিল চারপাশ মুখরিত।
ক্রেমলিন প্রাসাদে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরকারী দলের অপর সদস্যদের ক্রেমলিন প্রাসাদে অবস্থানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বঙ্গবন্ধুও তাঁর দলবল নিয়ে সেখানে অবস্থান করেন। একে সোভিয়েত সরকারের এক অনুপম মনোভাব বলেই গণ্য করা হয় সে সময়। সেখানকার কূটনীতিক মহল বিষয়টি নিয়ে আলাপ তুলে বলেন, সরকারপ্রধানের নয়, শুধু রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রাসাদে থাকার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। সরকারপ্রধান হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অবস্থান করেছিলেন এখানে এবং সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি সেখানে অবস্থান করেন।
১ মার্চ ১৯৭১, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা
১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলায় ‘গত বছর এই দিনে’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে। সেই দিন কী ঘটেছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়—সুদীর্ঘ তেইশ বছর পাকিস্তান বাংলাদেশকে করেছিল শোষণ ও বঞ্চনার ক্ষেত্র। তারই প্রতিবাদে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেদিন। দুপুর ১২টা। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির শেষ অঙ্কের প্রথম পর্বের নাটকের পর্দা উত্তোলিত হলো। ইথারে ভেসে এলো একটি খবর—৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা ছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। কয়েক মুহূর্তমাত্র। বিস্ময়ে হতচকিত বাংলাদেশ। কিন্তু তা কিছুক্ষণের জন্য। তারপর নেমে এসেছিল রাস্তায় মানুষের ঢল। কেউ ভাবতে পারেনি সেদিন সেই মুহূর্তে জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। সেদিন চলছিল কমনওয়েলথ বনাম পাকিস্তান তৃতীয় ক্রিকেট টেস্ট। প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল স্টেডিয়াম। খেলা ভন্ডুল। মুহূর্তে বেরিয়ে পড়লো শত শত শোভাযাত্রা। প্রচণ্ড বিক্ষোভে আইনজীবী থেকে ফেরিওয়ালা শোভাযাত্রায় অংশ নিতে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। কেউ বলেনি শোভাযাত্রায় অংশ নিতে, কেউ বলেনি পল্টনের জনসভায় যেতে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমগ্র ঢাকায় হরতাল অনুষ্ঠিত হলো।
সব পথ গিয়ে মিশলো পূর্বাণীতে
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের খবরটি রাষ্ট্র হতে সময় লাগেনি। যে যেখানে ছিল বেরিয়ে পড়েছে প্রতিবাদ জানাতে। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্বাণী হোটেলে। সেখানে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। জনতা মিছিল বের করে, মিছিল নিয়ে পূর্বাণী হোটেলের সামনে জমায়েত হতে থাকে। তারা পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে স্লোগান দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু তাদের ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানান। বিকালে পল্টনে স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজনে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি। সেই ষড়যন্ত্র যে কত জঘন্য ও মানবতাবিরোধী, তা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল।
রিকশাচালকদের আন্দোলন, ছবি: ২ মার্চ ১৯৭২ সালের পত্রিকা
রিকশাচালকদের অধিকার আদায়ে মিছিল
১৯৭২ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নেমে আসেন রিকশাচালকেরা। চার দফা দাবি আদায়ে তারা মিছিল নিয়ে বের হন। রিকশা মালিকদের দৈনিক জমার হার হ্রাস ও বাস্তুচ্যুত রিকশাচালকদের পুনর্বাসন এবং আরও কিছু দাবিসহ রিকশা মজদুর ইউনিয়ন ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের কাছে আবেদন নিয়ে যান।
রিকশা মালিকদের জমা দৈনিক তিন টাকা ও নতুন রিকশার জন্য চার টাকা ধার্য, বাস্তুচ্যুত রিকশাচালকদের বিনামূল্যে এক কাঠা করে জমি দান, পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারে নিহত বা শারীরিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রিকশাচালকদের পরিবারবর্গকে সাহায্য এবং রিকশাচালকদের রেশন কার্ডের সুপারিশ করা হয়।
মহামারী আকারে বসন্ত
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ছয় জেলায় প্রায় ৫০০ মানুষ বসন্ত রোগের কারণে মারা গেছে। সেই বছর বসন্ত মহামারী আকার ধারণ করে। রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর ও বরিশালে এর প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। যমুনা নদীর ওপারের উপদ্রুত এলাকাকে তিন ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের দায়িত্ব একজন ডেপুটি ডিরেক্টরকে দেওয়া হয়।
ধারণা করা হচ্ছিল, স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রত্যাগমনকারী বাস্তুত্যাগী মানুষের সঙ্গে বসন্ত রোগের জীবাণুও প্রবেশ করেছে। দীর্ঘদিন প্রতিষেধক টিকা না দেওয়ার কারণে ও গ্রামে গ্রামে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায়, এই রোগের জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০২০