উদিসা ইসলাম
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পুর্বনির্ধারিত রাশিয়া সফরের আগেই দুই দেশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় ফিল্ডওয়ার্ক করা হয়েছে। সেই সময় পত্র-পত্রিকায় বেশ আগে থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে বাংলাদেশের চাওয়া ও শর্তহীনভাবে কতটুকু সহযোগিতা তারা করবে, সেই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়ে আসছিল। সর্বশেষ সফরের আগের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে রাশিয়ার একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো নির্ধারণে তাদের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করে।
১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার। এদিন দুই দফায় ৯ ঘণ্টা ধরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চার দিনের সফরে রাশিয়া যাবেন। আগের দিনের এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তিনি। সভায় সব মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাশিয়া সফরের বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়ে সভায় আলোচনা হয় বলে পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সরকারিভাবে শুভেচ্ছা সফর
প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে বলে পর্যবেক্ষকরা অনুমান করছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সরকারিভাবে শুভেচ্ছা সফর বলে অভিহিত করে একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করাই এর উদ্দেশ্য বলে জানানো হয়। এই সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও প্রভাবের বিষয়ে সেই সময়ের বিশ্লেষণে বলা হয় যে, উভয় দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্য দেওয়ার প্রশ্নটিই বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করবে। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পর্যাপ্ত সাহায্যের কথা সেসময় সবার মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন এবং তাদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে উল্লেখ করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্বিন্যাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রহে সবরকম সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে অগ্রসর হওয়াটাই মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক ছিল।
সাহায্যের তালিকা ১৫০ কোটির!
বঙ্গবন্ধুর রাশিয়া সফরের আগেই বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে একটি তালিকা প্রকাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পণ্য প্রকল্প ও কারিগরি খাতে সাহায্য নেওয়ার জন্য সরকার যে তালিকা প্রণয়ন করে, টাকার হিসাবে তার দাম বা পরিমাণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল (অর্থনৈতিক) এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য সফরের এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় আসে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য প্রয়োজন হবে কিনা, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি ধারণাপত্রও তৈরি করেন তারা।
বাংলাদেশ বিত্তশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে
বাংলাদেশের সব সম্পদের যদি সদ্ব্যবহার করা হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। একথা বলেছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শ্রমিক দলের সদস্য স্টোন হাউস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে ছাত্র-শিক্ষকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ উক্তি করেন। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সভাপতি মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ আরও অনেকে।
জাতিসংঘের সমালোচনায় স্টোন
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য স্টোন হাউসের বক্তৃতার শুরুতে উপস্থিত সবাই ‘বাংলাদেশে ব্রিটিশ মোর্চা জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনিতে তাকে আহ্বান জানান। স্টোন হাউস বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারও দান নয়। লাখ লাখ বাঙালির রক্তে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।’ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা করেন। এটাকে তিনি ‘বৃহৎ শক্তির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা’ বলেও অবহিত করেন সেদিন।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে তারা ন্যূনতম দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, উল্লেখ করে স্টোন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এমনকি এই গণহত্যার বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপনের জন্যও পাঠানো হয়নি।’ তিনি বাংলাদেশের জনসাধারণকে তাদের ন্যায্য সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করে বলেন, ‘আগামীতে বাংলাদেশে আসার পূর্বে তিনি বাংলা শিখে আসবেন।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০