উদিসা ইসলাম
৭ মার্চের সফল সমাবেশ ও দিকনির্দেশনার পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কিছু ছাত্রনেতা ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ২০১৭ সালের এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কীভাবে তিনি সেই ভুল তথ্য দেওয়া থেকে ছাত্রনেতাদের বিরত করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। ওই বাসায় থাকার সুবাদে তিনি অনেক কিছুর সাক্ষী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়ার কারণে জনগণ হতাশ হয়ে ফিরেছে বলে বঙ্গবন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল।’
২০১৭ সালের ১০ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী সেই দিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আনেন।
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা সেদিন তার বাবার গাড়িবহরের সঙ্গেই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। জনসভা শেষে তাদের গাড়ি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ফুলার রোড দিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ফেরে। পথে রেসকোর্স ময়দান থেকে বাঁশের লাঠি হাতে স্লোগানমুখর স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে ফিরতে দেখেন তারা।
১৯৭২ সালের ৭ মার্চের পত্রিকাতেও এই একই চিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। সকাল থেকে মানুষ অপেক্ষায় ছিল ‘কী বলবেন বঙ্গবন্ধু’। দুপুরের আগেই রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু একে একে নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার মধ্যেই ছিল অসহযোগের শুরু—খাজনা ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনও টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দেওয়া যাবে না, প্রতিটি গ্রামে ও মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে। সবার কণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ স্লোগান গান। পত্রিকা বলছে, ফেরার পথেও তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পেয়ে উচ্ছ্বাস নিয়েই ফিরে যান।
কিন্তু জনগণ হতাশ হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধুকে তথ্য দেওয়ার চেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা কী উদ্দেশ্যে সেটা করেছিলেন তার খোঁজ নেওয়া দরকার।’ সেদিনের বিবরণ দিতে গিয়ে বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘সমাবেশ থেকে ফিরে আমি যখন ঘরের মধ্যে ঢুকলাম, ঠিক সেই সময়ে দেখি আমাদের কয়েকজন ছাত্রনেতা। তারা হঠাৎ দেখি বেশ উত্তেজিত। আব্বাকে বলছেন, ‘এটা কী হলো লিডার? আপনি স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে আসলেন না। মানুষ সব হতাশ হয়ে ফিরে গেলো।’ সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, আপনারা মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আপনারা এরকম মিথ্যা কথা বলেন কেন? মানুষ কোথায় হতাশ হয়ে গেছে? তাহলে আপনারা মানুষ দেখেননি। আমি কিন্তু মানুষ দেখতে দেখতে এলাম। মানুষের ভেতরে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আমি দেখলাম, তাতে আমি তো কারও মুখে কোনও হতাশা দেখলাম না। আপনারা কেন আব্বাকে এরকম মিথ্যা কথা বলেন। আব্বাকে এরকম মিথ্যা কথা বলবেন না।”
ফেরার পথে কী দেখেছিলেন বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সেদিন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ স্লোগান দিতে দিতে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছিল।’’
নোট ছাড়াই বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের ভিন্ন পাঠের জন্য সবসময় তার জ্যেষ্ঠকন্যা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন বক্তৃতা তথ্যসূত্র হিসেবে সামনে আসে। ৭ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিকভাবে কী বলার কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন, কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন— এসব নিয়ে সবসময়ই আগ্রহী হতে দেখা গেছে নতুন প্রজন্মকে। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অনেকটাই উন্মোচন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিছক বক্তব্য ছিল না। এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি নিজের মতো করেই এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর হাতে কোনও নোট ছিল না। তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বহুসংখ্যক মানুষ যারা তাঁর বক্তব্য শুনতে এসেছিলেন, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছিলেন।’
আর এই নিজের মতো করে বলার বিষয়টির পেছনে যে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসার ভূমিকা রয়েছে, সেটিও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। মায়ের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক লোক অনেক কথা বলতে পারে, তাদের কারও কোনও কথা শোনার প্রয়োজন নাই। তোমার যা মনে আসে তুমি শুধু তা-ই বলবে।’
‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠের অমর সেই বাণী যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করলো প্রতিটি বাঙালিকে। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুকে পরাজিত করে বাংলার দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে আনলো স্বাধীনতার লাল সূর্য।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০২০