উদিসা ইসলাম
পাঁচ দিনের সোভিয়েত সফর শেষে দেশে ফিরে এসে বিমানবন্দরে বিপুল সংবর্ধনা পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুপুর একটা থেকেই উৎসুক জনতা বিমানবন্দরের বাইরের সড়কে দুই দিকে দাঁড়িয়ে স্লোগানমুখর করে রেখেছিল চারপাশ। বঙ্গবন্ধু এই সফরকে ‘সাফল্যজনক’ বলে উল্লেখ করে সেই দিন সাংবাদিক ও জনতার উদ্দেশে মাইকে কথা বলেছিলেন। এতে করে এই বিশাল জনতার ভিড় সামলানো সম্ভব হয়েছিল। এর ঠিক একবছর আগে এইদিনে সারাবাংলা স্বাধিকারের আন্দোলনে জ্বলে উঠেছিল। আর বাংলার মানুষ অপেক্ষায় ছিল সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা জানার।
সোভিয়েত প্রত্যাগত বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাঁচদিনব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের পর ৬ মার্চ ঢাকায় ফেরেন। বিমানবন্দরে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয় জনতা। বেলা ২টা ২০ মিনিটে বিশেষ বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণ করলে অপেক্ষমান জনতা মুহুর্মুহু স্লোগানে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়। বিমানবন্দরের প্রবেশ পথে আগে থেকেই জনগণকে অপেক্ষা করতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। বেলা একটা থেকে রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে থেকে জয়বাংলা, বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী জিন্দাবাদ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
১৯৭২ সালের ৭ মার্চের পত্রিকা
বিমানবন্দরে মাইকে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু
দৈনিক বাংলার ১৯৭২ সালের ৭ মার্চের খবরে বলা হয়, সেদিন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা না বলে একইসঙ্গে জনতার উদ্দেশে মাইকে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার বাংলাদেশের জনগণকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’ তার ঐতিহাসিক সফরের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ‘সাফল্যজনক’ শব্দটি ব্যবহার করেন। বিমানবন্দরে অপেক্ষমান জনতার চাপে প্রধানমন্ত্রী নিয়মমাফিক সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে মাইকের সাহায্যে বক্তৃতা করেন। এর ফলে সাংবাদিকদের পক্ষে তার কথা শুনতে সহজ হয়। তিনি তার বক্তৃতায় আগাগোড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ও জনগণের আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘তাঁকে ও তাঁর দলের প্রতি যে স্নেহ মমতা আতিথেয়তা দেখানো হয়, সেটা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উদ্দেশেই দেওয়া হয়।’
কী কথা হলো?
সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছে, সে কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তারা উভয় দেশের জনগণের কল্যাণের কথা আলোচনা করা ছাড়াও বিশ্বশান্তির বিষয়ে আলোচনা করেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সোভিয়েত জনগণ জানে কী পরিমাণ রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তারা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করে।’
১৯৭২ সালের ৭ মার্চের পত্রিকা
কোসিগনি ও ইন্দিরাকে বঙ্গবন্ধুর বাণী
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোসিগনি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দুটি শুভেচ্ছা বাণী পাঠান। মস্কো সফর শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতীয় এলাকার ওপর দিয়ে ঢাকা ফেরার সময় তিনি এই দুই মন্ত্রীর কাছে শুভেচ্ছা বাণী পাঠান। কোসিগনির কাছে পাঠানো বাণীতে তিনি বলেন, ‘মহান সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে লিওনিদ ব্রেজনেভ, নিকোলাই পদগর্নি, সরকার ও জনগণকে আমাদের প্রতি প্রদর্শিত আতিথেয়তার জন্য আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মস্কো, লেনিনগ্রাদ ও তাশখন্দের জনগণকে। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকারের ফলে আমাদের দেশের বন্ধন আরও জোরদার হবে। অদূর ভবিষ্যতে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সফর করবেন— এই আশায় আমার দেশের জনগণ উদগ্রীব।’ এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পাঠানো বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দেশে ফেরার পথে আমি ভারতীয় এলাকার ওপর দিয়ে যাচ্ছি। এই সুযোগে আমি আপনাকে এবং ভারত সরকার ও ভারতের জনগণকে জানাচ্ছি— আমার আন্তরিক অভিনন্দন। সেখান থেকে ফেরার পথে আমি বোম্বেতে নেমেছিলাম। সেখানকার সরকার ও নেতৃবৃন্দ আমার প্রতি যে আতিথেয়তা প্রদর্শন করেছেন. তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনাকে ঢাকায় সংবর্ধনা জানানোর অপেক্ষায় রয়েছি আমরা।’
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের প্রতিবেদন এপ্রিলে
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কমিটি ১৯৭২ সালের এপ্রিলের শেষে রিপোর্ট দেবে বলে জানায়। বাংলাদেশ সরকারের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কমিটির কাজ ১৯৭২ এর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ব্যাপকভাবে শুরু হয়। ৫ মার্চ বিকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুর রহীম এই তথ্য প্রকাশ করেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই কমিটি বাংলাদেশে পাকবাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের জরিপ কাজ শেষ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহকারী কর্মীরা গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে কমিটির নির্ধারিত ফরমে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে দিয়েছেন। গণপরিষদের সদস্যরাসহ বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা এই জরিপ কাজে কার্যকরভাবে অংশ নেবেন বলে কমিটির চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘যেসব গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সত্যিই কষ্টকর হবে।’ তিনি বলেন, ‘তবে উনিয়ন কমিটি যদি কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেন, তাহলে ক্ষতি নিরূপণ করা যেতে পারে।’
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরই স্বরাষ্ট্র দফতরকে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এই প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৭২ সালের ৭ মার্চের পত্রিকা
একাত্তরের ৬ মার্চ আগুন জ্বলছিল
মার্চের শুরুতেই সারাদেশে স্বাধিকার আন্দোলনের আগুন জ্বলে ওঠে তীব্রভাবে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছে জেনে হতবাক বাঙালির প্রশ্ন— কীসের পরিষদ? শহীদের রক্তমাখা মিছিলে ‘পরিষদে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান ওঠে।
৭ মার্চ আসতে আর একদিন বাকি। পুরো বাংলাদেশ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সেই ৭ মার্চের জন্য, রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর জনসভার। জেল ভেঙে প্রায় তিনশ’ বন্দি পালিয়ে যায়। এরমধ্যে ১৬ জনকে আবারও আটক করা হয়। গুলিবর্ষণে ৩৭ জন আহত হয়। ছয় দিনব্যাপী হরতাল শেষ হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘ হরতাল আর কখনও হয়নি।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০২০