উদিসা ইসলাম
সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঁচ দিনের সফরের শেষে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলাপ-আলোচনার ইতি টেনে যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ যৌথভাবে কতটুকু সম্পাদন করতে পারবে, তার একটা রূপরেখা ৫ মার্চ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়— পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব জরুরি বিষয়ে উভয় সরকারের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হবে বলে দুই দেশের সরকার রাজি হয়েছে। যৌথ ঘোষণায় আন্তর্জাতিক প্রশ্নে, ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে উভয় দেশ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। দুই দেশের নেতারা বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে একমত হন।
ঠিক এর একবছর আগে একাত্তরের ৫ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল উত্তাল। সেই খবরও পত্রিকার পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল।
সোভিয়েত না থাকলে হতো না
সফরকালে উজবেক সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী নূর মোহাম্মদ হুদায়বারেভের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ বহুদিনের। ভারত আমাদের সাহায্য করেছে। তাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে আমাদের অসম যুদ্ধে সাহায্য করেছেন ও আমরা জয়ী হয়েছি। কিন্তু মহাশক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে না থাকলে আমাদের জয় হতো না।’
সোভিয়েত ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধুর বিদায় বাণী
কালের ব্যবধানে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে উল্লেখ করে পাঁচ দিনব্যাপী সফর শেষে বঙ্গবন্ধু বিদায়-বাণী দিয়ে স্বদেশভূমির উদ্দেশে রওনা দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ-সোভিয়েত ইউনিয়নের নিবিড় বন্ধুত্ব সময়ের ব্যবধানে আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রামে যে সহযোগিতা এবং সমর্থন সোভিয়েত সরকার ও জনগণ দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ তা ভুলবে না। সেসবই আমাদের দেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় রূপে বিরাজ করবে।’
৬ মার্চের পত্রিকার প্রতিবেদনঘোষণায় কী ছিল
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে আলোচনা শেষে যে যুক্ত ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়, সেই ঘোষণায় বলা হয়— ভিন্ন সমাজব্যবস্থা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থে সহযোগিতা বৃদ্ধি সম্ভব। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ঘোষণায় বলা হয়— অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দু'দেশের বিশেষজ্ঞরা অদূর ভবিষ্যতে বৈঠকে মিলিত হবেন এবং এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রণয়ন করবেন।
আন্তর্জাতিক ইস্যু
ঘোষণায় ইউরোপীয় নিরাপত্তা সম্মেলন আহ্বানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তত্ত্বাবধানে একটি বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহ্বানের বিষয়ে উদ্যোগের প্রতি বাংলাদেশ সরকার সমর্থন জ্ঞাপন করে।
বাংলাদেশ- সোভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশের সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানে আগ্রহী। কেবল বাইরের শক্তির কোনও রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া ও বাস্তব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার ও সাক্ষেরভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে তা হতে পারে।
১৯৭২ সালের ৫ মার্চের পত্রিকা
কেমন ছিল একাত্তরের এই দিন
স্বাধীনতার সংগ্রাম তত দিনে আরও জোরদার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। জনতার প্রতিরোধ এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতাকামী জাগ্রত বাঙালির সর্বাত্মক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে, দৈনিক বাংলার সংবাদের হিসাব অনুযায়ী, এদিনে (৫ মার্চ) নিহতের সংখ্যা ছিল ২২২ জন। হরতাল চলছে, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। এদিন নারায়ণগঞ্জে জনসভা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে পাক বাহিনীকে স্পষ্ট করে বলে দেন— ‘শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করুন।’ মওলানা ভাসানী সংকীর্ণ মনোভাব পরিহার করে সংঘবদ্ধ মুক্তিসংগ্রাম এগিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। শহরে লাঠি মিছিল হয় এদিন। একইসঙ্গে সেদিন লেখক, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সভা হয় বাংলার মাটিতে, তারা সংগ্রামের শপথ নেন এবং ঘোষণা করেন— তাদের লেখনী হবে সংগ্রামের বুলেট ও বেয়নেট।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ০৫, ২০২০