কেউ যেন তোমাদের বদনাম না করে, স্বেচ্ছাসেবক লীগকে বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম
স্বেচ্ছাসেবকদের কর্তব্য সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কেউ যেন তোমাদের বদনাম না করে। কারও ওপরে তোমরা অত্যাচার করেছ এমন কথা যেন আমি না শুনি। তোমাদের সম্পর্কে এমন কোনও অভিযোগ এলে আমার মুখে চুনকালি পড়বে।’

১৯৭২ সালের ১৪ মার্চ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক দলের সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যারা অস্ত্রের জোরে দেশ চালায় শুধু সেইসব সরকার দুর্বল হয়। আমাদেরকে দুর্বল ভাবলে ভুল করা হবে। আমাদের পেছনে সাত কোটি মানুষের সমর্থন রয়েছে।’ দেশের জনগণ বিশেষ করে যুব সমাজকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেশ গঠনমূলক কাজে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। প্রয়োজনে তিনি তাদের মাটি কাটার পরামর্শ দেন।

সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। আমাদের ধরে নিতে হবে যে মুক্তিসংগ্রাম এখনও চলছে এবং আরও তিন বছর চলবে এই মনোভাব ও উদ্যম নিয়ে এখন দেশ গড়ার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’

১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বর্তমান দুর্দশার ছবি তুলে ধরে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের ৩০ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছে। অসংখ্য মা-বোনকে নিগৃহীত হতে হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে যাবতীয় সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের এখন কিছু নেই। সম্পূর্ণ শূন্য হাতে সরকারকে কাজ শুরু করতে হয়েছে। জানি না কী করবো, কী করতে পারবো।’

চাকরি দিতে পারবোনা

এক শ্রেণির লোকের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এরা আমাদের অফিসের ভিড় করছে আর চাকরির দাবি জানাচ্ছে। সবাই বলছে, তারা ত্যাগ করেছে।’ এদের প্রতি দেশ গঠনের কাজে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাকরি দিতে পারবো না। কিছুই দিতে পারবো না। সবাই ত্যাগ করেছে। চাকরি দেবার আগে চাকরি সৃষ্টি করতে হবে।’

১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
১৯৭১ এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনকালে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যেভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিল তার প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা আমার নির্দেশে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। আবার আমাদের দেশে অস্ত্র ত্যাগ করেছেন। যারা আমার নির্দেশ মানেনি অস্ত্র জমা দেয়নি তারা দুষ্কৃতকারী।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশ বা সরকারি ক্ষমতা দিয়ে আমি দমন করতে চাই না। স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এ দায়িত্ব তোমাদের পালন করতে হবে। তোমাদের সঙ্গে থাকবে জনগণ। যারা অস্ত্র জমা দেয়নি তারা দুষ্কৃতকারী।’

যারা অস্ত্র জমা দেয়নি তারা দুস্কৃতিকারী

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার নির্দেশ অমান্য করে যারা আজ অস্ত্র জমা দেয়নি তারা আমাকে ভালোবাসে না। বাংলাদেশেও ভালোবাসে না। তারা দুষ্কৃতকারী।’

১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
তিনি বলেন, এই দুষ্কৃতকারীরা দেশে তাদের নিজেদের একটি পাল্টা সরকার বসাতে চায়। এরা এখন গ্রামে গ্রামে এবং বিভিন্ন এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘একদল লোক আমাদের আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে বেড়ান। আমাদের ঘোষিত চারটি আদর্শের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না।’

তিনি বলেন, ‘একটি আদর্শের ভিত্তিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে দেশ স্বাধীন করা যদি সম্ভব হয় থাকে তবে এদেরকে মোকাবিলা করা কঠিন হবে না। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি বলেন, ‘দেশ এখন স্বাধীন। যার যা খুশি লেখেন।’

তিনি বলেন, ‘এ সরকার শুধু আওয়ামী লীগের সরকার নয়, এ সরকার দেশের মানুষের সরকার।’

১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা

কারও কাছে মাথা নত নয়

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কোনও অবস্থাতেই তিনি কারও কাছে মাথা নত করতে পারবেন না। নাকে খত দিয়ে সাহায্য কিনে আনতে পারবেন না।’ বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, তথাকথিত বৈদেশিক সাহায্য ও সহযোগিতার নামে দেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবেন না। তিনি বলেন, টাকার জন্য তিনি কারও কাছে দেশ বন্ধক রাখতে পারবেন না। আপামর জনসাধারণকে দেশ গড়ার কাজে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি দেখতে চাই, বাংলার মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে আছে। দেখতে চাই, তাদের মুখে আনন্দের হাসি। দেখতে চাই, গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে লাঠি খেলা, চলছে নৌকাবাইচ।’

আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক দলকে জনসেবায় আত্মনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমাদের কাজ সাত কোটি মানুষের সেবা করা। মানবতার সেবাই সবচেয়ে বড় সেবা।’

রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়দানকারীদের সমালোচনা

বঙ্গবন্ধু বলেন, মানুষের মুখে হাসি ফুটুক তাই আমরা চাই। প্রয়োজন হলে, আমরা মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবো কিন্তু জনগণের সমর্থন হারাবো না। ১৬ ডিসেম্বরের পর যারা রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে শুরু করেছেন তাদের কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করে তিনি তাদেরকে সাবধান করে দেন।

প্রধানমন্ত্রী চোরাকারবারি ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করেন। তিনি বলেন, অবস্থার সুযোগ নিয়ে এরা চোরাকারবারি করছে। এদের দমন করতে তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, দেশ এখন স্বাধীন। স্বাধীনতা অর্থ বিশৃঙ্খলার নয়। চুরি দুষ্কর্ম চোরাচালান নয়। এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বৃথা যেতে দেওয়া হবে না।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২০

SUMMARY

2409-১.jpg

১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের পত্রিকা