এমরান হোসাইন শেখ
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পত্র-পত্রিকায় অবহেলিত ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকীতে দায়সারা গোছের সংবাদ পরিবেশন করা হতো। পঁচাত্তর পরবর্তী প্রথম কয়েক বছর এ চিত্র দেখা যায়। বর্তমানে গণমাধ্যমে ফলাও করে জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে পারলেও ওই সময় তা ছিল না। এজন্য পত্রিকাগুলোর বঙ্গবন্ধুবিরোধী মনোভাব ও সরকারের অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই সময় দায়িত্ব পালনকারী গণমাধ্যম কর্মীরা। তারা বলেন, সাংবাদিকরা যে সংবাদ লিখতেন, পত্রিকায় তা ছাপা হতো না। লেখার সময় জাতির জনক ও বঙ্গবন্ধু শব্দ দুটি বারবার লিখলেও ব্যবস্থাপনায় যারা ছিলেন তারা কেটে দিতেন। সাংবাদিকরা নিউজ লিখতেন একরকম, আর পরদিন পত্রিকায় ছাপানো হতো অন্যভাবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কয়েক বছরের বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সংবাদ পর্যালোচনা করেছে বাংলা ট্রিবিউনের গবেষণা সেল। এতে দেখা গেছে ১৯৭৬ সালে পত্রিকাগুলোর কোনোটিতেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কোনও সংবাদ নেই। পরের বছর ১৯৭৭ সালের পত্রিকায় বিশেষ করে ইত্তেফাক, সংবাদ ও দৈনিক বাংলা জন্মদিনের খবর ছাপে। তবে কোনোটিতেই ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘জাতির জনক’ শব্দ ব্যবহার হয়নি। সংবাদ ও ইত্তেফাকে বলা হয়, ‘ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা’র জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু তো নয়ই সেখানে আওয়ামী লীগের নামও ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে প্রথম সাহস দেখিয়েছে সংবাদ। ১৯৭৮ সালে পত্রিকাটি ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যবহারের পর ১৯৭৯ সালে তারা ‘জাতির পিতা’ লিখেছিল। ওই সময় হত্যার বিচারও দাবি করে পত্রিকাটি। প্রথমে অন্যের বক্তব্যের বরাত দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করলেও দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭৮ সালে কোট-আনকোটে ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যবহার করে। পত্রিকাটি ১৯৮৪ সালে ‘জাতির পিতা’ শব্দটি ব্যবহার করলেও পরের বছর ১৯৮৫ সালে আবারও সংবাদ প্রকাশে সংকোচন নীতি অনুসরণ করে। ওই সময় পত্রিকাটি ‘জাতির পিতা’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যবহার করে। ওই সময় জন্মদিনের নিউজটিও ছিল ছোট ও সাদামাটা।
পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে অবহেলার কারণ জানতে বাংলা ট্রিবিউন কথা বলেছে ওই সময়ে ইত্তেফাকে কর্মরত দুইজন সাংবাদিক ও সংবাদের দায়িত্বশীল একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে। তারা জানান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন তৎকালীন সরকারের পছন্দ ছিল না, এটা সত্য। পাশাপাশি অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও এসেছে কখনও কখনও। তবে, কেউ কেউ সাহস দেখিয়ে সংবাদ ছাপালে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েছে এমনটি নয়। তাদের মতে, গণমাধ্যমগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু শব্দ ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশন করতে পারতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুবিরোধী মনোভাব ও নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এটা তারা করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই সময় ইত্তেফাকে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘‘আমরা যারা ভেতরে থেকেছি তারা বিষয়টা ভালোভাবে জানি। পঁচাত্তরের পর আমরা বারবার ‘জাতির পিতা’ ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ দুটি নিউজ লেখার সময় ব্যবহার করতাম। কিন্তু পত্রিকার পলিসির কারণে তা কেটে ফেলা হতো। পত্রিকার (ইত্তেফাক) নিয়ন্ত্রক ছিল বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। মালিক পক্ষের একজন তো অসম্ভব বঙ্গবন্ধুবিরোধী ছিলেন। কাজেই অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এটা হয়েছে। ইত্তেফাকে আমি ‘ওপেন সিক্রেট‘ নামে একটা ধারাবাহিক লিখতাম- জিয়াউর রহমানের বদৌলতে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।’’
নিউজ পরিবেশনে সরকারের নির্দেশনা ছিল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বর্তমানে দৈনিক জাগরণ পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের সময় পত্রপত্রিকার ওপর সেনাবাহিনীর একটি অলিখিত নিয়ন্ত্রণ ছিল। এরশাদের আমলেও এর ধারাবাহিকতা ছিল। এটাই ছিল বাস্তবতা। যে কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা যায়নি।’
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের সংবাদ পরিবেশনার দৈন্যতার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘‘ছাপানোর দায়িত্বটা তো আমাদের নয়। আমরা নিউজ দিতে পারি, ছাপাতে পারি না। প্রতিবাদ করেছি। শফিকুর রহমান ও আমি সব সময় ‘জাতির জনক’ আর ‘বঙ্গবন্ধু’ লিখতাম। আমাদের অবস্থান ছিল আমরা লিখবো তারা কাটলে কাটুক। আমরা যেটা লিখলাম পরের দিন দেখতাম সেটা ছাপা হয়নি। একটা পর্যায়ে আমাদের আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হতো না। আমাকে তো শেষে রিপোর্টিং থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।’’
দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ বিটে দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র সাংবাদিক শফিকুর রহমানও একই ধরনের মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘ইত্তেফাকের মালিকদের দুজনই বঙ্গবন্ধু হত্যার সমর্থন করেছিলেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা তো পরের কথা আওয়ামী লীগের নিউজ ছাপানোটা চ্যালেঞ্জের ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। লিখতাম ঠিকই কিন্তু ছাপা হতো না।’
এক প্রশ্নের জবাবে বর্তমান আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান বলেন, ‘সামরিক সরকারের একটা বিধিনিষেধ ছিলই। তবে, আমরা এটাও দেখেছি এই বিধি-নিষেধের মধ্যেও কোনও কোনও পত্রিকা জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু লিখে গেছেন। তারা তো লিখতে ভয় পায়নি। ইত্তেফাক তো অনেক বেশি ক্ষমতাশালী পত্রিকা ছিল। তাদের ম্যানেজমেন্ট চাইলে এটা পারতো না- এটা আমার ওই সময় মনে হয়নি। তারা চাইলে পারতো কিন্তু করেনি। আর কেন করেনি মালিক পক্ষের কাছে জিজ্ঞাসা করলে এখনও জানা যাবে।’
তিনি জানান, আমরা আমাদের জায়গা থেকে লড়াই করেছি। আসাফ উদ দ্দৌলা রেজা, গোলাম সারওয়ার ভাইয়েরা চেষ্টা করতেন বঙ্গবন্ধুকে সম্মানজনক জায়গায় রাখতে, কিন্তু পারতেন না। আমরা এক একটা স্টোরিকে ৪/৫ বার লিখতাম কিন্তু তারা ছাপাতো না। বাধ্য হয়ে দুই-একবার বঙ্গবন্ধু লিখলেও কোট আন কোট করে তা দিতো।
সংবাদের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ুন বলেন, ‘যারা এটা করেছে দুটো কারণেই হতে পারে পত্রিকাগুলোর নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তা, আর অন্যটা হচ্ছে সরকারের নিষেধাজ্ঞা।’ সংবাদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কোনও কোনও পত্রিকা সরকারের নিষেধাজ্ঞা না মেনে বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কেউ কম্প্রোমাইজ করেছে আবার কেউ কেউ তা করেনি। সংবাদ প্রগতিশীল রাজনীতি ও বাঙালি জাতীয়বাদকে লালন করে বলেই এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি লয়াল ছিলা বলেই এই সাহসটা দেখিয়েছে। সংবাদ এটা দেখিয়েছে সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও চলতে পেরেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে সরকার নিজেরা সরাসরি কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। কেউ সাহস করলে তাকে বাধা দিতেও আসেনি। সংবাদ সাহস দেখিয়েছে ইত্তেফাক তা দেখাতে পারেনি। হয়তো কম্প্রোমাইজও করেছে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ইত্তেফাক পত্রিকা অফিস পোড়ানো হলো সংবাদ অফিসও পোড়ানো হলো। কিন্তু এরপর সংবাদের আহমেদুল কবির জেলে গেলেন- সংবাদ বের হলো না, আর ইত্তেফাক প্রকাশিত হলো। এটার কারণ অনুসন্ধান করলে অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০