এমরান হোসাইন শেখ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ১৭ মার্চ। ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে সরকার তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে। জীবদ্দশায় জন্মদিন উপভোগের খুব একটা সুযোগ তিনি পাননি। কারণ, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো সর্বকালের সেরা এই বাঙালির বেশিরভাগ জন্মদিন কেটেছিল কারাগারে। অবশ্য তিনি খুব একটা জন্মদিন পালন করতেন না। চেষ্টা করতেন এই দিনটিতে পরিবারকে সময় দিতে।
পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রায় ১৩ বছরের মতো কারাগারে কাটাতে হয়। তিনি মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকটি জন্মদিন কেটেছে। তাঁর ৪৭তম জন্মদিনও কেটেছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ওই সময় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা ঢাকায় থাকতেন।
কারাগারে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখা ডায়রিতে ১৯৬৭ সালে ৪৭তম জন্মদিনের কথা তুলে ধরেন। বাংলা অ্যাকাডেমি ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামে তার ডায়রিটি বই আকারে ২০১৭ সালে প্রকাশ করেছে। এতে তিনি লেখেন— নিজের জন্মবার্ষিকী কোনোদিন নিজে পালন করেননি। বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকতো। জন্মদিনে তিনি বাড়িতে থাকতে চেষ্টা করতেন বলে উল্লেখ করেন। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ ৪৭তম জন্মদিনটি পালন করছে বলে খবরের কাগজ মারফতে জানতে পারেন। জেলে বন্দি থাকায় জন্মদিন পালন হচ্ছে বলে তিনি ধারণা করেন। জন্মদিন পালন করছে দেখে তিনি হেসেছিলেন বলেও উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন- ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!’ তিন দিন আগে (১৪ মার্চ) স্ত্রী-সন্তানরা দেখতে এসেছিল। এমনটা চিন্তা করে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে জন্মদিনে দেখা করার অনুমতি পাবে কী না, সেই শঙ্কা থাকলেও তাঁর মন বলছিল— ‘যদি আমার ছেলে-মেয়েরা ও রেণু আসততো ভালোই হতো।’
জন্মদিনের ভোরে বন্দি নূরে আলম, চিত্ত রঞ্জন সুতার, সুধাংশু বিমল দত্ত ও এমদাদুল্লা সাহেব ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান বলে ডায়রিতে উল্লেখ করেন। ওই দিনের বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন— খবরের কাগজ পড়া শেষ করতে চারটা বেজে গেলো। ভাবলাম ‘দেখা’ আসতেও পারে। ২৬ সেলে থাকেন সন্তোষ বাবু, ফরিদপুরে বাড়ি। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী দলে ছিলেন, বহুদিন জেলে ছিলেন। এবারের মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে জেলে এসেছেন, আট বছর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রায় ১৭ বছর জেল খেটেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল হাসপাতালে প্রায়ই আসেন, আমার সঙ্গে পরিচয় আগে ছিল না। তবে একই জেলে বহুদিন রয়েছি। আমাকে তো জেলে একলাই অনেক দিন থাকতে হয়েছে। আমার কাছে কোনও রাজবন্দিকে দেওয়া হয় না। কারণ, ভয় তাদের আমি ‘খারাপ’ করে ফেলবো, নতুবা আমাকে ‘খারাপ’ করে ফেলবে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ২৬ সেলে যাবেন। দরজা থেকে আমার কাছে বিদায় নিতে চান। আমি একটু এগিয়ে আদাব করলাম। তখন সাড়ে চারটা বেজে গেছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলে-মেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায়নি। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, ‘চলুন, আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলে-মেয়েরা এসেছে।’ তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওনা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বছরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরিয়ে দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিলো। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলে-মেয়েদের চুমো দিলাম। দেখি, সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠিয়ে দিয়েছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সবাইকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে। ওর সঙ্গে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।
জন্মদিনে জেলখানায় একাধিক কেক পাঠানোর তথ্য তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু ডায়রিতে লিখেছেন— আরেকটা কেক পাঠিয়েছে বদরুন, কেকটার ওপর লিখেছে—‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে।’ বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠিয়েছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারলো না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারবো না।’ আমার ছেলে-মেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও।’
সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, ছয়টা বেজে গেছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলে-মেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নেই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেলো বাইরে থেকে। ভোরবেলা খুলবে।
আটটি জন্মদিন কেটেছে কারাগারে
স্বাধিকার আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অনন্ত আটটি জন্মদিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে তার ৩১তম জন্মদিনে কাটাতে হয় কারাগারে। পাকিস্তান সরকার তাকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি বন্দি করে। টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে কাটিয়ে তিনি মুক্তি পান ১৯৫২ সালে। ওই একই দফায় বন্দিদশায় ১৯৫১ সালে তার ৩২তম জন্মদিনও কাটে জেলে।
এরপর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে টানা এক হাজার ১৫৩ দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে কাটাতে হয়। গ্রেফতারের ১৪ মাসের মাথায় তিনি মুক্তি পেলেও সেদিনই কারা ফটকে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। এ সময় তার ৪০তম (১৯৫৯ সাল), ৪১তম (১৯৬০) ও ৪২তম (১৯৬১) জন্মদিন কাটে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দিদশায়।
ওই দফায় ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি আবারও গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান একই বছরের ১৮ জুন। ফলে ৪৩তম (১৯৬২) জন্মদিনটিও তাঁর কাটে জেলখানায়। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনের সময়ও তাঁকে জেলে থাকতে হয়েছে।
দুখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই-বা কী, আর মৃত্যু দিনই বা কী?
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ১৯৭১ সালের মার্চে যখন দেশ উত্তাল, তখন বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন এসে পড়ে। অবশ্য পত্রিকাগুলো ভুল করে ৫৩তম জন্মদিন উল্লেখ করেছিল। ১৭ মার্চ তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। তবে ৫৩তম নয়। পত্রিকায় ভুল ছাপা হয়েছে, আজ আমার ৫২তম জন্মদিন।’
তখন একজন বিদেশি সাংবাদিক জন্মদিন পালনের প্রসঙ্গ তোলেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী, আর মৃত্যু দিনই বা কী? আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন। এদেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোনও মহিমা। যখনই কারও ইচ্ছা হলো আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণের জীবনের কোনও নিরাপত্তাই তারা রাখেনি। জনগণ আজ মৃতপ্রায়। আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি জন্মদিন পালন করেন না। জন্মদিনে মোমবাতিও জ্বালান না, কেকও কাটেন না।ওই সময় সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’
তবে হাজার হাজার জনগণ সেদিন তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন। অনেকেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন শুভেচ্ছা সামগ্রী। শুধু তাই নয়, প্রিয় সংগ্রামী নেতার মঙ্গলময় জীবন কামনা করে শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিল শুভেচ্ছা বাণী।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবসে ঢাকার একটি গ্রামোফোন রেকর্ড প্রতিষ্ঠান, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড বের করেছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে একটি রেকর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে উপহারও দেয় ওই প্রতিষ্ঠান। ওইদিন জন্ম দিন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আছর নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করে মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০